বলে ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিরাট পরিবেশে কোথায় বুঝি এক অস্থির উন্মাদনা শুরু হল। মৃত্যুর তীর্থে তর্পণ করতে এসে বুঝি সকলেরই এমনি হয়। মনে হল, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যেন সেদিনকার সেই অমৃতবাণী শুনতে পেলাম। মনে হল, জীবন নেই, মৃত্যুও নেই। জীবন-মৃত্যু অতিক্রম করে এক অনাদি অনন্ত লোকের অমর অস্তিত্বের সাক্ষাৎ পেলাম। যথার্থ ত্যাগের বেদনাও বুঝি সত্যিকারের মুক্তির আনন্দ। মনে হল, আর একবার আসুক সেই অসহ্য বেদনা, যে-বেদনায় কান্নার অবসান ঘটে। আমরা সহজে সুখী হতে চাই, সহজে ঐশ্বর্যের মালিকানা পেতে চাই, তাই যন্ত্রণায় আমরা ছটফট করি; কিন্তু তেমন করে মন বুদ্ধি অহংকার সবকিছু থেকে মুক্তি না পেলে কেমন করে বলব তোমাকে পেলাম তোমাকে পাওয়ার দাম না দিলে তোমাকে পাওয়া যে আমার ব্যর্থ হয়। তাই সবকিছু থেকে মুক্ত হয়েই আজ তোমার সঙ্গে আমি যুক্ত হব। দয়া করে তুমি আমাকে মুক্ত হবার শক্তি দাও।
ততক্ষণে জগৎশেঠজি, মিরজাফর সাহেব, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, ছোটমশাই সবাই এসে গেছেন। আশেপাশের গ্রামের লোকরাও খবর পেয়ে গেছে। তারাও দলে দলে ভিড় করতে আরম্ভ করেছে।
সত্যিই, পুড়লে তোমার জ্বালা করবে না?
করবে কি করবে না, পরীক্ষা করেই না-হয় দেখো
কিলপ্যাট্রিক একটা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে এল। দাউদাউ করে জ্বলছে মশালের শিখা। মরালী আগুনের শিখার ওপর হাত বাড়িয়ে দিলে। হাতের পাঁচটা আঙুল পড়পড় করে পড়তে লাগল। ঝলসে কালো হয়ে গেল। দুর্গন্ধ বেরোতে লাগল।
তারপর বেঁকে তেবড়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে গেল। তবু মরালীর মুখে চোখে এতটুকু বিকার নেই।
এবার তুমি খুশি তো?
ক্লাইভের তখন আর উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই। নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে মরালীর মুখের দিকে। মরালীর মুখে চোখে তখন যেন অদ্ভুত এক হাসি ফুটে বেরোচ্ছে।
মরালী গিয়ে উঠল চিতার ওপর। কান্তর নিষ্প্রাণ দেহটা কোলের ওপর তুলে নিয়ে বসল। বললে–এবার আগুন জ্বালো
সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠল দাউদাউ করে। আগুন জ্বলে উঠল দমদম হাউসের উঠোনে, আর সমস্ত হিন্দুস্থানে। সে-আগুনের শিখায় দিল্লির বাদশা পুড়ে মরল, মারাঠা, শিখ, দাক্ষিণাত্য সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। তা যাক, কিন্তু তার বদলে এল স্টিম ইঞ্জিন, কলের জাহাজ, ধান ভাঙার কল, কাপড় বোনার মেশিন, গান শোনানোর গ্রামোফোন, ছবি তোলার ক্যামেরা।
জগৎশেঠজি, মিরজাফর, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, নবকৃষ্ণ, ছোটমশাই, মুনশি রামচাঁদ, ম্যানিংহাম, ওয়াট, বিচার, সবাই যেন সেই আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। মিরজাফরের শেষের দিকে কুষ্ঠব্যাধি হয়েছিল, নন্দকুমারের হাতে গঙ্গাজল খেয়েও রোগভোগ থেকে মুক্তি পায়নি। আর মিরন! মিরনের মৃত্যুও বড় মর্মান্তিক। বজ্রাঘাত ঠিক খুঁজে খুঁজে বেছে বেছে তার মাথা লক্ষ করেই পড়বে একথা কে ভাবতে পেরেছিল? আর উমিচাঁদকে অনেকে দেখেছে রাস্তায়। রাস্তায় প্রলাপ বকতে বকতে ঘুরত কেবল। শেষের দিকে কুড়ি লাখ টাকার শোক তার মতো কোটিপতিকেও একেবারে বিকল করে দিয়েছিল। তারপর আর তাকে দেখতে পাওয়া যায়নি।
আর এই যে আজ লালবাজারের চারদিকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান আর আরমানিদের ভিড়, এরা সেই ক্লাইভ সাহেবের নজরানা পাওয়া এগারোজন বেগমেরই উত্তরপুরুষ। বংশানুক্রমিকভাবে এরা এখানেই বাস করছে।
আর হাতিয়াগড়ের ছোট বউরানি? বার-মহলেই কেটে গিয়েছিল তার শেষ জীবনটা। বউ বউরানি শেষ বয়েসে পোষ্যপুত্র নিয়েছিল। তারাই হাতিয়াগড়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছিল। হাতিয়াগড়ের বড়-তরফ। ছোট বউরানির নিজের কোনও সন্তান হয়নি। তিনি পোষ্য নিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমানের ছোঁয়া খাওয়ার অপরাধে সে-তরফ আজও অন্ত্যজ। হাতিয়াগড়ের রাজবংশের কোনও মর্যাদার অংশীদার তাঁরা হতে পারেননি।
*
হঠাৎ পশুপতিবাবু ঘরে ঢুকলেন। চা-ও এল।
আমি জসিম সাহেবকে বললাম ইনিই সেই উদ্ধব দাসের বংশধর। মেরী বেগম খ্রিস্টান হবার পর নিজের পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে উদ্ধব দাসের বিয়ে দিয়েছিল। আমি পুঁথি পড়ে সব জানতে পারলাম উনি কিছুই জানতেন না এসব
জসিমউদ্দিন সাহেব বললেন–একবার সেখানা আনুন না, দেখি একটু
পশুপতিবাবু বললেন–সে এক মজার ব্যাপার হয়ে গেছে মশাই, আপনাকে দেখাবার পর আমি দু’-একজনকে কথাটা বলি, তারপর একজন আমেরিকান সাহেব সেদিন এসেহঠাৎ সেটা নিয়ে গেল
নিয়ে গেল মানে? আর দেবে না?
পশুপতিবাবু বললেন না, তিনি যে দেড়শো টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে গেলেন!
সেকী? একেবারে বিক্রি করে দিলেন? সে-সাহেবের ঠিকানাটা কী?
পশুপতিবাবু বললেন–তাও তো জানি না মশাই, ছাপোষা গেরস্থ মানুষ। নগদ দেড়শো টাকা পেয়ে গেলুম, আমি আর ঠিকানাটা চাইনি–
কী আর করব। সেদিন আর কিছু করবারও ছিল না আমাদের। আমরা খালি হাতেই ব্যর্থ হয়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু যতবার কাহিনীটার কথা মনে পড়ে ততবার দুশো বছর আগেকার সেই কোন এক আশ্চর্য মেরী বেগমের কথা মনে পড়ে অসাড় হয়ে যাই। মনে হয়, এমন একদিন হয়তো আসবে যেদিন আমাদের আজকের এই কুটিল আর জটিল পৃথিবীর মানুষের ভিড়ের মধ্যে একজন মানুষের আবির্ভাব হবে, যে বলতে পারবে আমার মন বুদ্ধি আর অহংকার সবকিছু থেকে মুক্তি না পেলে কেমন করে বলব তোমাকে পেলাম! তোমাকে পাওয়ার দাম না দিলে যে তোমাকে পাওয়া আমার ব্যর্থ হয়। তাই সবকিছু থেকে মুক্ত হয়েই তোমার সঙ্গে আমি যুক্ত হব। দয়া করে তুমি আমাকে মুক্ত হবার শক্তি দাও।