আমি জসিম সাহেবকে বললাম-এইহচ্ছে পশুপতিবাবুর ছেলে। এঁরা খা-বিশ্বাস। ক্লাইভসাহেব দিল্লির বাদশার কাছ থেকে উদ্ধব দাসের জন্যে খাস-বিশ্বাস উপাধি এনে দিয়েছিল। নিজেরও নতুন উপাধি আনিয়েছিল।
কিন্তু তারপর কী হল?
বললাম–তারপর সে এক অদ্ভুত কাণ্ড। সেই ভোররাত্রে যখন উদ্ধব দাস কান্তসাগর থেকে এসে হাজির হল তখনও বিশ্বাস করেনি যে, এমন কাণ্ড ঘটবে। মেজর কিলপ্যাট্রিক সেদিন যখন পদ্মার ওপর ছ’খানা বজরা আক্রমণ করলে তখন মিরন আর কোনও উপায় না পেয়ে সবগুলো বেগমকে ডুবিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কিলপ্যাট্রিকের ফৌজের দলের লোকেরা অত সহজে ছাড়েনি তাদের। তারাও সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। যাদের যাদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তারা কেউই বেঁচে ছিল না। শুধু কান্তর চোখের পাতা দুটো বোধহয় একটু নড়ছিল। আর সবাইকে রেখে তারা তাকেই নিয়ে এসেছিল দমদম হাউসে। কিন্তু তারও পরমায়ু তখন বুঝি ফুরিয়ে এসেছে। যেটুকু বাকি ছিল তাও রাস্তাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। মেজর কিলপ্যাট্রিক সেই প্রাণহীন শরীরটাকেই বয়ে নিয়ে এসেছিল দমদম হাউসের উঠোনে।
ক্লাইভ প্রথমে বলেছিল কবর দিতে।
কিন্তু মরালী বললে–না, শবদাহের ব্যবস্থা করতে হবে
তা সেই ব্যবস্থাই হল শেষপর্যন্ত। কাঠ এল, পুরুতমশাইও এল। চিতা সাজানো হল। একদিন যে-মানুষ চকবাজারের রাস্তায় গণতকারের কাছে হাত দেখিয়ে ভবিষ্যৎ জানতে চেয়েছিল, তার ভবিষ্যৎ দমদম হাউসের উঠোনের ওপর আগুনে পুড়িয়ে ছাই করবা সব ব্যবস্থাই পাকা করা হল। চিতার ওপর শোয়ানো হল কান্তকে। জ্বলন্ত আগুনের শিখায় শব ভস্ম করার হিন্দু রীতি যথাযথ পালন করা হল। ক্লাইভ সাহেব কোনও কিছুর ত্রুটি রাখতে দিলে না। মরালী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যেকটা জিনিসের ব্যবস্থা করে দিলে। ঘি চাই, চাল চাই, ফুল, চন্দন, যা-কিছু প্রয়োজন সব সাহেবকে বলে জোগাড় করালে। তারপর চিতায় আগুন লাগাবার পালা।
হঠাৎ মেরী বেগম বললে–থামুন পুরুতমশাই, আমি আসছি
বলে বাড়ির ভেতর চলে গেল। খানিক পরে যখন ফিরে এল তখন একটা নতুন লালপাড় শাড়ি পরেছে। সিথিতে সিঁদুর দিয়েছে। পায়ে আলতা পরেছে। কপালে টিপ! আস্তে আস্তে সাজানো চিতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে ক্লাইভ সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বললে–কোথায় যাচ্ছ?
মরালী বললে–আমাকে বাধা দিয়ো না
ক্লাইভ সাহেব চমকে উঠেছে। বললে–সেকী, তুমিও চিতায় উঠবে নাকি?
মরালী বললো, হ্যাঁ আমাকে এবার আর তুমি বাধা দিয়ো না।
বলছ কী তুমি? তুমি কি হিন্দু? তুমি যে এখন খ্রিস্টান হয়েছ?
মরালী বললে–না, এবার তুমি আর আমাকে বাধা দিয়ো না। একবার অনেকদিন আগে ও দেরি করে এসেছিল, এবার ও আগে এসেছে, এবার আমাকে আর তুমি দেরি করিয়ে দিয়ো না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে যেতে দাও, পথ ছাড়ো
সেই অস্পষ্ট ভোরবেলায় নির্জন দমদম হাউসের উঠোনে দাঁড়িয়ে ক্লাইভ সাহেবের বড় ভয় করতে লাগল। মেজর কিলপ্যাট্রিক তখন হতবাক হয়ে গেছে। মেরী বেগম সতী হবে নাকি? হিন্দু মেয়েরা যেমন মৃত স্বামীর চিতায় উঠে পুড়ে মরে, তেমনই করবে নাকি! সঙ্গের ফৌজি সেপাইরাও তখন তাজ্জব হয়ে মেরী বেগমের কাণ্ডকারখানা দেখছে।
সরো তুমি!
ক্লাইভ বললে–না, তোমাকে আমি কিছুতেই পুড়ে মরতে দেব না
মরালী এবার খানিকক্ষণ সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল। তারপর বললে–তুমি আমায় বাধা দেবার কে?
কিন্তু তোমার নিজের স্বামী তো বেঁচে রয়েছে।
কিলপ্যাট্রিক সাহেব তাড়াতাড়ি একজন সেপাইকে পাঠিয়ে দিলে কান্তসাগরে উদ্ধব দাসকে ডেকে পাঠাতে। উদ্ধব দাস এসে সব শুনে চুপ করে রইল।
ক্লাইভ বললে–পোয়েট, তুমি তোমার ওয়াইফকে পুড়ে মরতে বারণ করো। তুমি বারণ করলে শুনতে পারে, আমার কথা শুনছে না–বারণ করো, বারণ করো
উদ্ধব দাস সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে হাসতে লাগল।
কী পোয়েট, তুমি বারণ করবে না? তুমি তোমার ওয়াইফকে চোখের সামনে পুড়ে মরতে দেখবে?
মরালী বললে—আমি এখন কারও বারণ শুনব না, আমাকে ছেড়ে দাও-
-কিন্তু পুড়লে তোমার জ্বালা করবে, তোমার যন্ত্রণা হবে, তখন তুমি বাঁচবার জন্যে ছটফট করবে।
মরালী হাসল-না সাহেব, জ্বালা করবে না
আগুনে পুড়লে জ্বালা করবে না? বলছ কী তুমি?
সাহেব, তুমি তা হলে আমাকে চিনতে পারেনি। তোমার সঙ্গে যে এগারোজন বেগম মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছে, আমি তাদের মতো বেগম নই, আমি তাদের থেকে আলাদা।
আলাদা তা জানি, কিন্তু তা হলেও তোমারও তো প্রাণ আছে, অন্য সকলের মতো তোমারও তো ফিলিং আছে, তোমারও তো হাঙ্গার আছে, কেটে গেলে তোমার বডি দিয়েও রক্ত পড়ে।
মরালী বললে–না, নেই!
তার মানে? আগুনে পুড়লে তোমার জ্বালা করবে না?
না! তুমি পরীক্ষা করে দেখো!
*
হঠাৎ পশুপতিবাবু ঘরে ঢুকলেন। আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেছেন। ভদ্রলোক ছাপোষা মানুষ। অফিস থেকে ফেরবার পথে একেবারে বাজার করে আনছেন। হাতে বাজারের থলি। তাতে কপি, মুলো, পালংশাক, বেগুন উঁকি মারছে।
বললাম–এঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি হচ্ছেন কবি জসিমউদ্দিন, ইউনিভার্সিটির রিসার্চ স্কলার। ওই বেগম মেরী বিশ্বাসের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন–
পশুপতিবাবু বললেন–সে এক মজার ব্যাপার হয়ে গেছে মশাই, আমি বলছি, জামাকাপড় বদলে আমি আসছি। আর আপনাদের চা-ও করতে বলি