পেগি ডাকলে–কী হল রবার্ট? উঠে গেলে কেন? কী হল?
রবার্ট তখন পাশের ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আজ তোমরা কেউ আমার নও। আমি তোমাদের জন্যে ইন্ডিয়াতে এম্পায়ার তৈরি করে দিয়েছি। তবু তোমরা আমাকে চোর বলে ডাকাত বলে গুন্ডা বলে অভিহিত করেছ। তোমাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছ আমাকে। আমাকে গালাগালি দিয়েছ, আমাকে শাস্তি দিয়েছ, আমাকে অসম্মান করেছ…
রবার্ট! রবার্ট!
হঠাৎ ভেতর থেকে একটা পিস্তলের আওয়াজ হল আর সঙ্গে সঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত মজবুত হয়ে গড়ে উঠল দুশো বছরের মতো।
এখন যেখানে ওয়েস্ট ক্যানেল রোড আর ইস্ট ক্যানেল রোড দু’ফাঁক হয়ে দু’দিকে চলে গেছে, তারই মাঝখানকার ভূখণ্ডটুকুর ওপর ছিল সেদিনকার ক্লাইভ সাহেবের জমিদারি। দমদম ক্যান্টনমেন্ট, আর সেই বিরাট দমদম হাউসের বড় বড় গোল গোল থামগুলো আজও ছাদটা মাথায় নিয়ে দু’শ বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে গেছে জোড়া জোড়া লম্বা রেললাইন। রেলে চড়ে যারা যায় তারা কেউ জানে না কেউ চেনে না ওবাড়িটাকে। তারা জানেও না যে একদিন এখানেই এসে হাজির হয়েছিল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, নবাব মিরজাফর আলি, হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই, জগৎশেঠজি। ওর সামনে ছিল জলাজমি। এখনকার সল্ট লেক ওই দমদমের বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যেত দিগন্ত জুড়ে বিরাজ করছে। এখনও ওখানে সেই বিরাট বটগাছটার পাতা থেকে শিশির পড়ে টপ টপ করে। কান্তসাগর বুঝি এখন আর নেই। তার জায়গায় রেফুইজিদের বাড়ি উঠেছে সার সার। রাত্রে সেখানে এখনও জোনাকি জ্বলে, গাছের ডালে বাদুড়গুলো কিচকিচ করে, মাথার ওপর দিয়ে একটা এরোপ্লেন ঘুরে ঘুরে উড়ে যাবার সময় একটু ধোঁয়া ছেড়ে মেঘের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।
উদ্ধব দাসের শাস্তি পর্ব থেকেই জানা যায়, সেদিন যখন ভোররাত্রে উদ্ধব দাসকে কান্তসাগরের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসে ক্লাইভ, তখন মনসুরগঞ্জের একটা কামরার মধ্যেও ডাক এসেছিল নতুন নবাব মিরজাফর সাহেবের, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ডাক এসেছিল কৃষ্ণনগরে আর হাতিয়াগড়েও ডাক এসেছিল ছোটমশাইয়ের। জগৎশেঠজিকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকেছিল দেওয়ানজি রণজিৎ রায় মশাই।
কে?
জগৎশেঠজি ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। কী খবর?
দেওয়ানজি বললে–কর্নেল ক্লাইভ খুব রেগে গেছে। আবার বোধহয় লড়াই করতে আসবে মুর্শিদাবাদে।
সেকী? কেন, আবার কী হল হঠাৎ? সব তো মিটমাট হয়ে গিয়েছিল।
দেওয়ানজি বললে–না, সেজন্যে নয়, গোলমাল বাধিয়েছে মিরন, সে ধরা পড়েছে
মিরন ধরা পড়েছে?
ধরা পড়েনি ঠিক, কিন্তু বেগমদের নিয়ে যখন পালাচ্ছিল তখন কিলপ্যাট্রিক সাহেব তাদের তাড়া করে। মিরন তাড়াতাড়ি সবগুলো বেগমকে পদ্মায় ডুবিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।
তারপর?
তারপর আর কী? আমাকে এখন মনসুরগদিতে ডেকে পাঠিয়েছিল মিরজাফরসাহেব। নবাব বড় ভাবনায় পড়েছে। একে চুক্তির পুরো টাকাটা দিতে পারেনি, তার ওপর এইবারের কিস্তির উনিশ লক্ষ টাকা দিতে হবে, এখন যদি আবার রেগে গিয়ে ক্লাইভসাহেব বেশি টাকা চায়–
জগৎশেঠজি বললেন–আমাকে কী করতে হবে?
নবাব বলছিল, আপনি যদি একবার ক্লাইভসাহেবের দমদমার বাগানবাড়িতে যান
আমি?
কথাটা ভেবে দেখছিলেন জগৎশেঠজি। ফরাসিদের কাছে সাত লক্ষ টাকা হাওলাত দেওয়া আছে জগৎশেঠজির। সে টাকাটা ফিরিঙ্গিদের খুশি রেখে আদায় করতে হবে। তাদের এখন চটানো ভাল নয়। বললেন–ঠিক আছে, তা হলে নবাবকে খবর দাও, আমি যাব
এমনি করে মিরজাফর সাহেব কৃষ্ণনগরেও খবর পাঠিয়েছিল। মহারাজের ঘুম ভাঙিয়ে খবর দিলেন কালীকৃষ্ণ সিংহমশাই। তিনিও তৈরি হয়ে নিলেন ক্লাইভ সাহেবের দমদমার বাগানবাড়িতে আসবার জন্যে।
হাতিয়াগড়ে জগা খাজাঞ্চিমশাইও ঘুম থেকে ডেকে তুললে ছোটমশাইকে। ছোটমশাইও তৈরি হলেন। তার বজরা তৈরি হল নদীর ঘাটে।
সবাই ভেবেছিলেন দমদমাতে গিয়ে কর্নেল সাহেবের রাগ ভাঙাতে হবে। হয়তো আরও টাকা কবুল করতে হবে। ফিরিঙ্গি মানুষ। চশমখোরের মতো। প্রায় দু’শশা নৌকো ভরতি টাকা-পয়সা-গয়না নিয়ে গিয়েছে সিন্দুক বোঝাই করে। তাতেও পেট ভরেনি। চব্বিশ পরগনার জমিদারি পেয়েও খুশি হয়নি। হয়তো আরও কিছু চায় বেটা।
কিন্তু দমদম হাউসের সামনে মাঠে গিয়ে অবাক। সেখানে অনেক ভিড় জমেছে মানুষের। আশেপাশের গাঁ থেকে পিলপিল করে দলে দলে ছেলেবুড়ো-মেয়েরা আসছে ক্যান্টনমেন্টের মাঠে। ফৌজের লোকেরা পঁড়িয়ে আছে চারদিক ঘিরে। মেজর কিলপ্যাট্রিক আছে, ওয়াটস আছে, বিচার, ম্যানিহাম আছে, আর আছে ক্লাইভ সাহেব! আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে মুনশি নবকৃষ্ণ আর রামচাঁদ।
পালকিগুলো কাছে যেতেই জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে গেল। কাকে যেন ঘিরে সবাই বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় আতকে নিঝুম হয়ে আছে।
ক্লাইভ সাহেব জগৎশেঠজিকে দেখেই এগিয়ে এল গুড মর্নিং
জগৎশেঠজি জিজ্ঞেস করলেন–কী হচ্ছে এখানে? এত ভিড় কীসের?
ততক্ষণে মিরজাফর, কৃষ্ণচন্দ্র, ছোেটমশাই সবাই এসে পড়েছেন।
তারাও অবাক হয়ে গেছেন। বললেন–ও কে? ওখানে শুয়ে কে?
*
জসিমউদ্দিন সাহেবকে নিয়ে পশুপতিবাবুর বাড়িতে যখন পৌঁছোলাম তখন বেশ সন্ধে হয়ে গেছে। পশুপতিবাবু তখন বাড়িতে নেই। একজন ছেলে দরজা খুলে দিলে। বললে–আপনারা বসুন, বাবা এখনও আপিস থেকে ফেরেননি, তিনি এখুনি এসে পড়বেন।