কান্ত বললে–কোথায়?
যেখানে তোমার খুশি। কিন্তু এখানে আর নয়, এ-দেশে আর নয়! যেখানে নবাব-আমির-ডিহিদার-মিরবকশি কেউ নেই, এইবার সেই দেশে চলে যাব।
যদি কেউ তোমার নিন্দে করে? যদি কেউ তোমাকে একঘরে করে?
মরালী বললে–এখন আমি কাকে আর পরোয়া করব বলো? আমি যাদের যাদের বাঁচাতে চেয়েছিলাম, তাদের কেউই রক্ষে পায়নি। নবাবকে খুন করে মেরেছে মিরন, হাতিয়াগড়ের ছোট বউরানিকেও তারপর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কী যে সব হয়ে গেল! যাক, তবু তুমি যে শয়তানদের হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছ, এই-ই আমার ভাগ্য! এখন আমার নিন্দে রটলেই বা কী? আর তা ছাড়া, আমি তো আর এখন হিন্দু নই, এমনকী মুসলমানও নই, এখন আমি এখানকার গির্জায় গিয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছি, এখন কে আমাকে কী বলবে? কার অত সাহস হবে!
কান্ত বললে–তা হলে চলো
মরালী বললে–চলো—
কোথায় যাবে?
মরালী বললে–যেখানে তোমার খুশি সেখানেই চলো—
বলে উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ বাইরে থেকে ডাক এল–বেগমসাহেবা, বেগমসাহেবা
আর সঙ্গে সঙ্গে মরালীর ঘুম ভেঙে গেছে। কোথায়? কোথায় গেলে তুমি? অন্ধকারের মধ্যে চারদিকে চেয়ে মরালীর চোখ দুটো অস্থির হয়ে উঠল। নেই, কোথাও নেই সে! এতক্ষণ তা হলে স্বপ্ন দেখছিল নাকি?
বাইরে থেকে আবার ডাক এল–বেগমসাহেবা–বেগমসাহেবা
তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে আসতেই মরালী দেখলে সামনের উঠোনে অনেক মানুষের ভিড়। দূরে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে ক্লাইভ সাহেব। তার পাশে মেজর কিলপ্যাট্রিক। আর তার পাশে ওয়াট, তার পাশে ম্যানিংহাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হোমরাচোমরা সাহেবরা সবাই এসেছে। আর সকলের পেছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে উদ্ধব দাস। কারও মুখে টুঁ শব্দটি নেই।
মরালী সকলের মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে রইল। তোমরা আমাকে ডেকেছ কেন? কী হয়েছে। তোমাদের? তোমরা কথা বলছ না কেন? বলল, কথা বলো!
সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ নজরে পড়ল, কে যেন মাটির ওপর শুয়ে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল মালীর। এক নিমেষে সামনে এগিয়ে গেল। কে তুমি? তুমি কে? কে? কে?
বলতে বলতে মরালী সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর তার মনে হতে লাগল যেন দূর থেকে একটা অস্ফুট প্রার্থনার বাণী ভেসে আসছে। তুমি তাকে সুখী করো ঈশ্বর। সে যেন মুর্শিদাবাদের পাপ আর পঙ্কিলতা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। সে যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়–
দূরে বিরাট বটগাছটার ডালে বাদুড়গুলো কিচকিচ শব্দ করতে লাগল। ক্যান্টনমেন্টের ফৌজি সেপাই ঘণ্টা-ঘড়ি পিটিয়ে প্রহর গুনতে লাগল–ঢং ঢং ঢং ঢং..
*
এর অনেক পরের কথা। আমি তখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র।
রাস্তায় জসিমউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে একদিন দেখা। তখনও বিশ্ববিখ্যাত কবি হননি জসিম সাহেব। এম-এ ক্লাসে বাংলা পড়ি। আর জসিম সাহেব ইউনিভার্সিটির বাংলা ডির্পাটমেন্টের রিসার্চ স্কলার। কবি হিসেবে সেই সময়েই তিনি বাংলাদেশে সুবিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনকে বাংলা পুঁথির সন্ধান দেন। কোথাও নকশাকাটা মাটির হাঁড়ি, পুতুল, কাঁথা পেলে এনে দেন দীনেশ সেন মশাইয়ের কাছে। ইউনিভার্সিটি সে পুঁথি ভাল দাম দিয়ে কিনে নেয়।
জসিম সাহেবকে একদিন বললাম একটা ভাল পুঁথির সন্ধান পেয়েছি জসিমসাহেব, আপনি দেখবেন?
কীসের পুঁথি? কী পুঁথি? নাম কী?
আমি বললাম–নাম বেগম মেরী বিশ্বাস।
জসিম সাহেব কৌতূহলী হলেন। অদ্ভুত নাম তো! মুসলমান বটে, খ্রিস্টানও বটে, আবার হিন্দুও বটে! কত বছরের পুরনো?
বললাম-মনে হচ্ছে, শ’দুয়েক বছর আগেকার। পলাশির যুদ্ধের ব্যাপার নিয়ে লেখা! কবির নাম উদ্ধব দাস। প্রায় হাজারখানেক পাতার পুঁথি!
জসিম সাহেব বললেন–জাল নয় তো? আজকাল আবার কাঠকয়লার ধোঁয়া লাগিয়ে পাতাগুলোকে পুরনো করবার কায়দা শিখেছে লোকরা।
বললাম–মনে তো হয়, তা নয়। আপনি পুঁথি এক্সপার্ট, আপনি একবার দেখলেই বুঝতে পারবেন।
কত চাইছে?
বললাম–চাইছে না কিছুই। বেচা-কেনার কথাই ওঠেনি। শুধু একবার আপনাকে দেখতে বলছি, কবে যাবেন বলুন। বেশি দূরে নয়, বাগবাজারের খালের ধারে
জসিম সাহেব সব শুনে বলেছিলেন–ঠিক আছে, যাব একদিন
সেসব কতদিনের কথা। তারপরে কত কাণ্ড হল। যুদ্ধ বাধল। বোমা পড়ল। দুর্ভিক্ষ হল। হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাধল। দেশ ভাগাভাগি হল। বলতে গেলে ওলটপালট হয়ে গেল সব। জসিমউদ্দিন সাহেবও পাকিস্তানে চলে গেলেন। এখন হয়তো আর সেসব কথা মনেও নেই তার।
মনে না থাকবারই কথা। কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি। বেগম মেরী বিশ্বাসের একবারে শেষ পর্বে অর্থাৎ শান্তি পর্বে যে কাহিনী লিখে গেছেন উদ্ধব দাস, তার বুঝি তুলনা নেই প্রাচীন সাহিত্যের ইতিহাসে।
দিন পনেরো পরেই জসিমউদ্দিন সাহেবকে নিয়ে গেলাম পশুপতিবাবুর বাড়িতে।
পথে সমস্ত গল্পটা বলতে বলতে চললাম। জসিম সাহেব খুব আগ্রহভরে শুনছিলেন। থামতেই বললেন–তারপর?
আমি তখন বেগম মেরী বিশ্বাসের পাতার মধ্যে যেন অবগাহন করে আছি।
বললাম–কোন পর্যন্ত বলেছি?
জসিম সাহেব বললেন–সেই যে মরিয়ম বেগমকে ধরে আনা হল পদ্মার ওপরে বজরা থেকে মরালী ঝাঁপিয়ে পড়ল…।
বললাম–উদ্ধব দাস এই শান্তি পর্বের মধ্যেই সমস্ত বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্যের নির্যাসটুকু দিয়ে গেছেন। পুঁথিটা যদি হারিয়ে যায় কিংবা নষ্ট হয়ে যায় তো বাংলাদেশের একটা দিক লুপ্ত হয়ে যাবে চিরকালের মতো। কারণ, পুঁথির পাতা ছাড়া তার কোনও চিহ্ন আর কোথাও নেই। চেহেল্-সুতুন নেই। সেই জাফরগঞ্জ নেই, মনসুরগঞ্জ নেই। মিরজাফর, মিরন, মিরকাশিম, মিরদাউদ, মেহেদি নেসার, রেজা আলি কেউ নেই। এমনকী সেদিনকার সেই ক্লাইভসাহেবও নেই। দিল্লির বাদশার কাছ থেকে পাওয়া সেই উপাধি জবরদস্ত-উল-মুলক নাসেরদ্দৌলা সবত জঙ বাহাদুর কর্নেল ক্লাইভও ইতিহাস থেকে উবে গেছে। কোথায় যে তাকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল তার চিহ্নমাত্র নেই। ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর তারিখে তাস খেলতে বসে ক্লাইভ সাহেব কী তাস হাতে পেয়েছিল কে জানে। হয়তো কুইন অব স্পেক্স। ইস্কাবনের বিবি। সেই ইস্কাবনের বিবিটা হাতে নিয়ে পাশের ঘরে উঠে গিয়েছিল।