তুমি কাঁদছনাকি? তোমার বাংলা মুলুকের নবাব খুন হল বলে তুমি কাঁদছ? কিন্তু নবাবকে যদি আজ বাঁচিয়ে রাখি তো তোমাদের ভাটার কাল যে আর কাটবে না। তোমাদের গোরুর গাড়ি আর নৌকোর যুগ যে শেষ হবে না কোনওকালে।
কিন্তু তখন আর কাঁদলে কী হবে। যা হবার তা তো হয়ে গেছে। তখন সেই সিরাজ-উ-দ্দৌলার মৃতদেহটাই একটা হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে। একবার মহিমাপুর, একবার চকবাজার, একবার মনসুরগঞ্জ, একবার জাফরগঞ্জ, আর সকলের শেষে এসে থেমে গেল চেহেল্-সুতুনের সামনে।
তোমরা দেখো তোমাদের মরা নবাবকে, আর কাদো। চোখ মুছতে মুছতে তোমরা ভাববা যে মুর্শিদাবাদের নবাবের এই শাস্তি কেন হল। যেনবাবকে কুর্নিশ না করলে একদিন তোমাদের গর্দান যেত, আজ ইচ্ছে করলে তার মুখে থুতুও ফেলতে পারো। কেউ গর্দান নেবে না, কেউ বাধা দেবে না, কেউ বারণও করবে না। খোদা হাফিজ!
*
শেষ সময়ে বেগমদের বড় কষ্ট হয়েছিল। নানিবেগম জীবনে কখনও এমন করে টানাপোড়েনের হাতিয়ার হননি। আমিনা বেগম, ঘসেটি বেগম, ময়মানা বেগম, সবাই নবাব আলিবর্দির আদরে মানুষ হয়েছে। তুমি কোথায় নজর আলি! তোমাকে খুঁজতে আমি চেহেতুন থেকে বেরিয়ে একদিন চকবাজারের রাস্তায় নেমেছিলাম। রাস্তায় নেমে সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানে গিয়ে উঠেছিলাম। তুমি এখন কোথায় নজর আলি?
নানিবেগম বোধহয় একমাত্র বেগম যার মুখে সেদিন কোরানের বাণী উচ্চারিত হয়েছিল। খোদাতালাহ, তোমাকে বরাবর আমি ভয় থেকে রক্ষে করতে বলেছি, বিপদ থেকে রক্ষে করতে বলেছি, মৃত্যু থেকে রক্ষে করতে বলেছি। কিন্তু কখনও তো ব্যর্থতা থেকে রক্ষে করতে বলিনি, জড়তা থেকে রক্ষে করতে বলিনি, তোমার অপ্রকাশ থেকে রক্ষে করতে বলিনি। আজ তার জন্যে তুমি আমায় শাস্তি দাও খোদাতালাহ!
উদ্ধব দাস লিখে গেছে–ছ’টা বেগমকে যখন একসঙ্গে মিরন সেই গভীর রাত্রে পদ্মার জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল তখন কারও মাথায় বজ্রাঘাত হয়নি, কোথাও উল্কাপাত হয়নি, একটা তারাও খসে পড়েনি মাটিতে।
কিন্তু একজনের আর্তি বুঝি কেউই শুনতে পায়নি। সে কান্ত। কান্তর আর্জি মিরন শোনেনি, মেজর কিলপ্যাট্রিক শোনেনি, আকাশ বাতাস-অন্তরীক্ষ-ঈশ্বর-খোদা-গড কেউই শুনতে পায়নি। শুধু বোধহয় শুনতে পেয়েছিল মরালী। দমদম ক্যান্টনমেন্টে ক্লাইভ সাহেবের বাগানবাড়িটার একটা ছোট ঘরে শুয়ে ছিল সে। সারাদিন পরে নিজের হাতে এক মুঠো ভাত সেদ্ধ করে কোনওরকমে পেটে দিয়েছে। দূরে, অনেক দূরে বিরাট বটগাছটার ডগায় তখন কয়েকটা বাদুড় কিচকিচ করে চিৎকার করছে। ঘণ্টা বাজিয়ে প্রহর গুণছে ক্যান্টনমেন্টের ফৌজি সেপাই। এক–দুই তিন। রাত গভীর। বটগাছটার পাতা থেকে শিশির পড়ছে টপ টপ করে। আর কান্তসাগরের একটা কুঁড়েঘরের ভেতরে বসে বসে তখনও খাগের কলমে ভুযো কালি দিয়ে উদ্ধব দাস একমনে লিখে চলেছে বেগম মেরী বিশ্বাস। আমি তোমাদের জন্যে রাত জেগে জেগে এই মহাকাব্য লিখে চলেছি। এমনি এক রাতে একদিন হাতিয়াগড়ের অতিথিশালার মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলাম। সেও ঠিক এমনই রাত। তখন জীবনকে তাচ্ছিল্য করেছিলাম, মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করেছিলাম, বিবাহকেও অস্বীকার করেছিলাম। কিন্তু তারপর অনেক জন্ম, অনেক মৃত্যু, অনেক বিবাহ দেখেছি। অনেক উত্থান, অনেক পতন, অনেক চক্রান্ত অতিক্রম করেছি। কিন্তু বুঝেছি মৃত্যু যাঁর ছায়া, অমৃতও তারই ছায়া। তাই মৃত্যু আর অমৃত তার কাছে দুই-ই সমান। বুঝেছি যার কাছে সব দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি তিনিই চরম সত্য। পাপ আর পুণ্য, অর্থ আর পরমার্থ, সম্মান আর অপযশ, সমস্তই সেই চরম সত্যের কাছে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। তার কাছে সব খণ্ড খণ্ড সত্তার বিচ্ছিন্নতা সম্মিলিত হয়ে ওঠে।
ওমা, তুমি?
কান্তর মুখখানা যেন সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
মরালী ধড়মড় করে উঠে বসল। বললে–তোমার এরকম চেহারা হয়েছে কেন? আমি যে তোমাকে কতদিন থেকে খুঁজছি! সব জায়গায় তোমার খোঁজ করতে সাহেবের লোক গেছে। কোথায় ছিলে তুমি?
মরালীর মনে হল কান্তর চোখ দিয়ে যেন জল গড়িয়ে পড়ছে।
একী, তুমি কাঁদছ?
মরালী আঁচল দিয়ে কান্তর চোখ দুটো মুছিয়ে দিলে। বললে–এবার আমি তোমার কথা শুনব। জানো, একদিন তুমি আমাকে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলেছিলে, সেদিন যাইনি। কিন্তু আজ আমি তোমার সঙ্গে চলে যাব। তোমার দেশ বড়চাতরা, সেখানেই চলে যাব দুজনে। লোকে যা-ই বলুক, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।
কান্তর মুখ দিয়ে এতক্ষণে যেন কথা বেরোল। বললে–জানো, আমার বড় কষ্ট হচ্ছে
কষ্ট? কীসের কষ্ট? এবার তুমি আমার কাছে এসে গেছ, এবার আর তোমার কোনও কষ্ট থাকবে না। এবার আমি তোমার কাছে কাছে থাকব! ওই মিরনটা বড় বদমাইশ লোক, ওরা সবাই বদমাইশ। মেহেদি নেসার, মিরন, মিরদাউদ, মিরকাশিম, রেজা আলি, মিরজাফর, সবাই বদমাইশ। আমি সাহেবকে বলে এবার সবাইকে জব্দ করব। সবাইকে মসনদ থেকে হটাব। ওরা থাকতে কারও শান্তি নেই।
কান্ত চুপকরে শুনছিল। বললে–ওদের কথা থাক এখন, শুধু তোমার কথা বলল, তুমি সুখী হয়েছ
মরালী বললে–না না, ওদের কথা থাকবে কেন? ওরা বেঁচে থাকতে কি আমাদের সুখ হবে?
তারপর একটু থেমে বললে–তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বোসো। তোমাকে খোঁজবার জন্যে আমি সাহেবকে বলে সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছিলাম, জাহাঙ্গিরাবাদে, পূর্ণিয়ায়, আজিমাবাদে, হুগলিতে, কোনও জায়গায় খুঁজতে আর বাকি রাখেনি তারা। ভালই হল, তুমি ফিরে এসেছ। এবার চলল, আমার সঙ্গে এবার চলো