ওমা, তুমি!
হঠাৎ যেন বটগাছের ডালে বাদুড়দের কিচকিচ শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।
তুমি কোত্থেকে এলে? কোথায় ছিলে তুমি এতদিন? ওরা তোমায় কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল?
ওদিকে নিজের কুঁড়েঘরটার ভেতরে প্রদীপের শিখাটা আর একটু বাড়িয়ে দিলে উদ্ধব দাস। এবার শান্তি পর্ব লিখতে বসেছে। ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্যের শেষ পর্ব। একটা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে একটা জীবনের শেষ পর্ব, একটা যুগের অন্তিম পর্ব।
কিন্তু সাহেব যে বললে–মিরন নাকি তোমায় কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল? সেখান থেকে পালিয়ে এলে কী করে?
যদি বলে তিনি প্রেমস্বরূপ, তা হলে মানুষের পৃথিবীতে এত দুঃখ কেন, এত বিচ্ছেদ কেন? কেন বিরোধ এত আঘাত করে? কেন মৃত্যু এত হরণ করে? যদি বলে তিনি মঙ্গলময়, তা হলে মানুষের পৃথিবীতে এত অমঙ্গল কেন? তবে কি এই মন, এই বুদ্ধি, এই অহংকার, এরই জন্যে এত বিরোধ, এত মৃত্যু, এত অমঙ্গল! আমি তো সব ছেড়েছিলুম। সংসারের বন্ধনের মধ্যে আমি তো আবদ্ধ হইনি, স্বার্থের বন্ধনেও তো আমি বাঁধা পড়িনি। কামনা বাসনা-স্বার্থ সবকিছু ত্যাগ করেই তো আমি হরির দাস হয়েছিলুম। কিন্তু কই, মন বুদ্ধি আর অহংকার তো আমি ত্যাগ করতে পারিনি!
দেখো, তুমি এসেছ ভালই হয়েছে, এবার চলো আমরা দুজনে কোথাও চলে যাই, আজ তুমি যেখানে যেতে বলবে, সেখানেই যাব। আজ আমি তোমার কথা রাখব, আজকে আর আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না
লিখতে লিখতে দাঁড়ি বসাল উদ্ধব দাস। অনেক রাত হল। ক্যান্টনমেন্টের ঘণ্টা-ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারবার বাজল।
বিছানার এক পাশে উদ্ধব দাসের স্ত্রী শুয়ে ছিল। আলোটা নেবাতেই ঘুম ভেঙে গেছে। বললে–লেখা শেষ হল?
কিন্তু উত্তর দেবার আগেই বাইরে থেকে ডাক এল–দাসমশাই, ও দাসমশাই
এত রাত্রে ফৌজি সেপাইয়ের ডাক কেন হঠাৎ?
উদ্ধব দাস বাইরে এল। সেপাইটা মশাল জ্বেলে নিয়ে এসেছে। ভাল করে ভোর হয়নি তখনও।
কী হল? ডাকো কেন?
আজ্ঞে, মেরী বেগমসাহেবা ডেকেছে আপনাকে।
কেন? এত ভোরে আমাকে কেন? সাহেব এসেছে?
সেপাইটা বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ, কর্নেল সাহেব এসেছে, কিলপ্যাট্রিক সাহেব এসেছে। মরিয়ম বেগমসাহেবা ধরা পড়েছে জাহাঙ্গিরাবাদে, তাকেও এনেছে
আচ্ছা চলো–বলে উদ্ধব দাস গায়ে চাদর জড়িয়ে নিলে।
*
সেদিন কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল। বেশ ছিল সবাই। মুর্শিদাবাদের মসনদে বসে মিরজাফর সাহেব তখন আগ্নেয়গিরির উত্তাপে ছটফট করছে। খাজাঞ্চিখানায় টাকা নেই। মুর্শিদকুলি খাঁ যা-কিছু সম্পত্তি জমিয়ে রেখে গিয়েছিল, নবাব সুজাউদ্দিন খাঁ তা সবই উড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তারপর নবাব আলিবর্দি খাঁ সারাজীবন বাদশাহি পেষকস দিতে দিতে আর বর্গিদের হাঙ্গামা মেটাতেই সব খরচ করে ফেলেছিল। শেষ তিন বছর অবশ্য কিছু জমেছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলা সেই জমানো টাকা মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সব খরচ করে গেছে। তারপর এসেছে কর্নেল ক্লাইভ। ক্লাইভ টাকার তাগাদায় অস্থির করে মারে। কেবল বলে–টাকা দাও, আরও টাকা দাও
তারপর মিরজাফর সাহেব দেখলে মসনদ পেয়েছে বটে, কিন্তু মুর্শিদাবাদের মসনদ চালাতে চায় ক্লাইভ। তারপর আছে ঘরের শত্রু বিভীষণ! রাজা দুর্লভরাম লুকিয়ে লুকিয়ে দল পাকায়।
আর মিরন?
তারও দেখা নেই। ক্লাইভ তাকে খুঁজে বার করবার জন্যে হুকুম পাঠায় সেখান থেকে। বেগমদের নিয়ে সে একবার যায় জাহাঙ্গিরাবাদে। সেখানে কিছুদিন লুকিয়ে থাকার পর হঠাৎ খবর আসে ক্লাইভের লোক তার পিছু নিয়েছে। তখন দুটো বজরা আবার আশ্রয় খোঁজে আর একটা ঘাটে। এক ঘাট থেকে আর-এক ঘাটে লুকোচুরি খেলে বেড়ায় নবাব-নিজামত!
সেদিন আর ঠেকানো গেল না। পদ্মর মাঝখান দিয়ে চলেছে ছ’খানা বজরা। হঠাৎ মনে হল যেন পেছন পেছন ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে!
মিরন চিৎকার করে উঠল–চালাও, জোরসে চালাও
দুটো বজরা তিরের বেগে ছুটে চলতে লাগল জলের স্রোতে। সামনে অন্ধকার, পেছনে অন্ধকার। অন্ধকারের সমুদ্রে জোয়ারের টান পড়ল হঠাৎ। আকাশ বাতাস উন্মাদ হয়ে উঠল। পেছনে বজরার দাড়ের শব্দ কানে আসছে।
চালাও, চালাও, জোরসে চালাও।
ফিরিঙ্গি ফৌজ ভেবেছে কী? লঙ্কাবাগের লড়াইতে জিতেছে বলে কি মুর্শিদাবাদের মসনদ তার দখলে চলে গিয়েছে? মসনদ তো মিরজাফর আলি মহবৎ জঙ আলমগিরের। তাতে তুমি শরিকানা ফলাতে আসো কেন? আমি বেগমদের নিয়ে যেখানে খুশি রাখব, যা খুশি করব, আমার ইচ্ছে হলে আমি তাদের খুন করে ফেলব।
দূর থেকে কিলপ্যাট্রিক সাহেবের গলার আওয়াজ এল-হল্ট-হল্ট
মিরন আবার চিৎকার করে উঠল জোরসে চালাও জোরসে
কিন্তু জোরে চালাতে বললেই নৌকো জোরে চলে না। ভেতরের জোর না থাকলে বাইরে সে দুর্বল হয়ে পড়বেই। নবাব আলিবর্দির সময় থেকেইনবাব নিজামত ফতুর হয়ে গিয়েছিল। যেটুকু জোর তার তখনও ছিল তাও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার সময়ে। আজ সেনবাব নেই, আজ সেইনবাব নিজামত আরও দুর্বল। আজ প্রাণপণে বইঠা ঠেললেও নৌকো চলবে না। আজ সমুদ্রের ওপার থেকে আর এক ফৌজ এসেছে। তাদের তেজ আরও বেশি, তাদের জোর আরও তীব্র, তাদের বিক্রম আরও ভয়ংকর। তারা অনেক দূর থেকে আসছে। তোমার গোরুর গাড়ি, তোমার নৌকোর যুগ শেষ হয়ে এসেছে। এবার তাদের দেশ থেকে আসছে স্টিম ইঞ্জিন,কলের জাহাজ, ছাপাখানা। আসছে ধান ভাঙার কল, কাপড় বোনার মিল। আসছে নোট ছাপানোর মেশিন, আসছে গান শোনানোর গ্রামোফোন, আসছে ছবি তোলার ক্যামেরা। এবার ওদের জোয়ার এসেছে, আর তোমাদের ভাঁটা। ওদের সঙ্গে তোমরা পারবে কেন?