গলার আওয়াজ শুনেই ছোটমশাই অবাক হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু বড় বউরানির গলা আবার শোনা গেল ছোটমশাইকে বল, বাড়ির অন্দরে যেন ছোট বউরানিকে নিয়ে না ঢোকে।
সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে বড় বউরানির হুকুম শুনে।
ছোটমশাই এগিয়ে যাচ্ছিল। একেবারে সিঁড়ির মুখে ওপর-নীচে মুখোমুখি দেখা। ছোটমশাই বললে–কী বলছ তুমি?
ওপর থেকে তেমনি গম্ভীর গলাতেই বড় বউরানি বললে–হ্যাঁ, ঠিক বলছি–ছোট বউরানিকে এ বাড়িতে আর ঢুকিয়ো না
কিন্তু এবাড়িতে ঢুকবে না তো কোথায় যাবে ও?
বড় বউরানি বললে–তা এ-বাড়ির বাইরে কি আর মাথা গোঁজবার জায়গা নেই কোনও চুলোয়–
মাথা গোঁজবার জায়গা? বড়বউ, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না–কোথায় থাকবে ছোটবউ? ওর কি বাপের বাড়ি আছে যে, সেখানে যাবে?
বাপের বাড়ি না থাকে তো হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে বার-বাড়িও তো আছে, সেখানে থাকবে!
পালকি থেকে নেমে বড় বউরানির কথাগুলো কানে যেতেই মাথাটা যেন ঘুরতে লাগল। দুর্গা ছোট বউরানিকে ধরে ফেললে, নইলে হয়তো পড়েই যেত।
বড় বউরানি তখন ওপর থেকে বলছে–ছোটর বালিশ-বিছানা অন্দরমহল থেকে বার-বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আজ থেকে সেখানে শোবে ছোট।
ছোটমশাই ওপর দিকে তেমনি করে মুখে তুলে জিজ্ঞেস করলে–আর আমি?
বড় বউরানি বললে–তোমার যেখানে খুশি সেখানে শোবে! তোমাকে ভেতর বাড়িতে শুতে তো কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি?
বলে আর কথা বাড়াল না বউ বউরানি। পা বাড়িয়ে ভেতরের দিকে চলে গেল। ছোটমশাই আর কিছু উত্তর দিতে পারলে না। সেখানেই পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ।
.
কিন্তু মরালীকে বেশিদিন থাকতে হয়নি দমদম হাউসে! তবু যে ক’দিন ছিল রোজ একবার করে গির্জায় যেত। বিশেষ করে যেত রবিবার দিনটায়। দমদমায় ফিরিঙ্গি পাদরি সাহেব মরালীর নাম দিয়েছিল মেরী। লোকে বলত–মেরী বেগম।
বিরাট ক্যান্টনমেন্ট। তখনও ক্যান্টনমেন্ট পুরো হয়নি। কিন্তু সাহেবের ফৌজের লোকেরা থাকত কাছেই। বিরাট বিরাট হাতি আর ঘোড়ার আস্তাবল। তারপর রাস্তার মোড় ঘুরলেই সাহেবের বাগানবাড়ি। বাগানবাড়িটাও বিরাট। সামনের ফটকে পাহারা দিত ফৌজের লোক। বিনা মঞ্জুরিতে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিত না।
আর ক্লাইভ? ক্লাইভ সাহেবের তখন অনেক কাজ। অষ্টাদশ শতকের রাজনীতি তখন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। মিরজাফর সাহেবের সঙ্গে তখন ঝগড়া বেধে গেছে কোম্পানির। এক-একদিন হঠাৎ ঝড়ের মতো এসে হাজির হয় সাহেব।
সাহেব ঘরে ঢুকেই যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
মরালী বলে–কী হল তোমার?
আবার সেই ব্যথাটা বেড়েছে! কাল রাত্তিরে ঘুমোতে পারিনি। আবার সে এসেছিল
কে?
সেই সাকসেস। ঠিক সেইরকম ভাবে ঘরে ঢুকেছিল।
তারপর? সেই ঘুমের ওষুধটা খেলে না কেন?
কে ওষুধ দেবে? কেউ তো কাছে ছিল না।
শেষকালে দেশে চলে গিয়েও রোগটা যায়নি সাহেবের। ইন্ডিয়া জয় করতে এসে ইন্ডিয়াই শেষকালে ক্লাইভ সাহেবকে জয় করে ফেলেছিল। সাহেব শেষজীবনে আফিম খাওয়া শুরু করেছিল। আফিমই তাকে শেষপর্যন্ত গ্রাস করেছিল। চিঠিতে পোয়েটকে লিখেছে, সেই আগেকার মতোই রাত্রিবেলা ঘুমের ঘোরে সেই লোকটা আসে। সেই সাকসেস। কেবল বলে সাকসেস মানেই সাফারিং। সেখান থেকেও মরালীর কথা লিখত সাহেব। দি গ্রেট লেডি। দি গ্রেট লেডি অব বেঙ্গল। সেখানে গিয়েও মরালীকে ভুলতে পারেনি সাহেব। মরালী মারা যাবার অনেক দিন পরেও চিঠি লিখত, কিন্তু একদিন আর চিঠি এল না। চিঠি এল মেমসাহেবের।
মনে আছে তখন ক’দিন খুব ভাবনায় পড়েছিল মরালী। সাহেব একবার আসে, আবার চলে যায়।
বলে–পূর্ণিয়ায় যাচ্ছি ।
কিন্তু সেদিন আর ছাড়লে মরালী। বললে–বলল, কিছু খবর পেলে কিনা
সাহেব বললে–বলেছি তো, কিলপ্যাট্রিককে পাঠিয়েছি খুঁজতে
কিন্তু একটা মানুষকে খুঁজতে ক’দিন লাগে।
সাহেব বললে–মিরন যে বড় শয়তান, সে যে-সব বেগমদের নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে, কেউ জানে না কোথায় রেখেছে তাদের
তা হলে তোমরা আছ কী করতে? অতগুলো মেয়েমানুষকে নিয়ে সে তো উড়ে যেতে পারে না, নিশ্চয়ই কোথাও আছে।
ক্লাইভ বললে–জাহাঙ্গিরাবাদে নেই, আজিমাবাদে নেই, পূর্ণিয়ায় নেই, হুগলিতে নেই–সব জায়গায় দেখা হয়েছে
তা হলে আর কোথায় যেতে পারে সে?
আমিও তো তাই ভাবছি।
কিন্তু সেদিন হঠাৎ এসে হাজির হল কান্ত। বাগানবাড়িটার এক কোণে তখন ঘুমিয়ে পড়েছে মেরী বেগম। দূরে, অনেক দূরে বিরাট বটগাছের ডগায় কয়েকটা বাদুড় কিচকিচ করে চিৎকার করছে। ঘণ্টা বাজিয়ে প্রহর গুনছে ক্যান্টনমেন্টের ফৌজি সেপাই। এক দুই তিন। রাত গভীর। বটগাছটার পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা শিশির পড়ছে টপ টপ করে। আর কান্তসাগরের একটা কুঁড়েঘরের ভেতরে। বসে বসে খাগের কলমে ভুযো কালি দিয়ে উদ্ধব দাস একমনে লিখে চলেছে বেগম মেরী বিশ্বাস। আমি তোমাদের জন্যে রাত জেগে জেগে এই মহাকাব্য লিখে চলেছি। এমনই এক রাতে একদিন হাতিয়াগড়ের অতিথিশালায় গিয়ে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ঠিক এমনই রাত সেদিন। তখন জীবনকে তাচ্ছিল্য করেছিলাম, মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করেছিলাম, বিবাহকেও অস্বীকার করেছিলাম। কিন্তু তারপর অনেক জীবন, অনেক মৃত্যু, অনেক বিবাহ দেখেছি। অনেক উত্থান, অনেক পতন, অনেক চক্রান্ত। অতিক্রম করেছি। আজ বুঝেছি, মৃত্যু যাঁর ছায়া, অমৃত তারই ছায়া। তাই মৃত্যু আর অমৃত তার কাছে দুই-ই সমান। বুঝেছি, যাঁর কাছে সব দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি তিনিই চরম সত্য। পাপ আর পুণ্য, অর্থ আর পরমার্থ, সম্মান আর অপযশ সমস্তই সেই চরম সত্যের কাছে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। তার কাছে গিয়ে সব খণ্ড সত্তার বিচ্ছিন্নতা সম্মিলিত হয়ে ওঠে।