অন্ধকার ঘরখানার ভেতরে যেন দম আটকে আসছি ক্লাইভের। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল নতুন নবাব সুজা-উল-মুলক মিরজাফর আলি খাঁ মহবৎ জঙ আলমগির। তার পাশে জগৎশেঠজির দেওয়ানজি রণজিৎ রায়, তার পাশে নবাবের শ্বশুর ইরেজ খাঁ, তার পাশে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, তার পাশে মেহেদি নেসার। মিরদাউদ, মিরকাশিম, ডিহিদার রেজা আলি, আর তার পাশে হাতিয়াগড়ের রাজা ছোটমশাই, মেজর কিলপ্যাট্রিক, বিচার, ওয়াটস্ সবাই। সকলের মুখ যেন মূক হয়ে গেছে ইতিহাসের বিচার দেখে। আর তার পাশে বশির মিঞা।
কোথা থেকে একটা কানামাছি ভোঁ ভোঁ করতে করতে একেবারে নবাব মির্জা মহম্মদের ঘাড়ের ওপর এসে বসল। বসে পাখা নাড়তে লাগল। আর তারপর বলা নেই কওয়া নেই একেবারে ঠোঁটের ওপর। সেই ঠোঁটের ওপর বসেই মাছিটা হাত-পা ছুঁড়তে লাগল একমনে। কারও দিকে হৃক্ষেপ নেই। চারদিকে যে এত বড় বড় আমির-ওমরাহ দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকেও খেয়াল নেই।
ক্লাইভের আর সহ্য হল না। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমালটা বার করে সেই দিকে দোলাতে লাগল–ভাগো, বি অফ, বি অফ অফ
সবাই মাছিটাকে লক্ষ করেছিল। কারও এমন করে মনে লাগেনি। কারও এমন করে মনে হয়নি যে, বীরের অপমান সমস্ত মানুষের অপমান। বীরকে এমন করে অপমান হতে দিলে মানুষকেই অপমান করা হয়।
মাছিটা উড়ে এসে ক্লাইভের মুখের কাছে বার দুই ভোঁ ভোঁ করলে। সেটাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ক্লাইভ বললে–একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দাও বডিটা–
বলে মুখ ফিরিয়ে ঘরের বাইরে চলে এল। নতুন নবাব মিরজাফর সাহেবও পেছনে পেছনে এসেছে।
কর্নেল!
মুখ ফেরাল ক্লাইভ।
কসুর মাফ করবেন কর্নেল!
কেন? হোয়াই? কী হয়েছে?
আমি জবান দিয়েছিলুম যে, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে দরবারে আপনার হাতে নজরানা দেব। কিন্তু আমি কথা রাখতে পারিনি।
ক্লাইভ সেকথায় কোনও কান দিলে না। যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগল।
মিরজাফর সাহেব তখনও পেছনে পেছনে আসছে!
নবাব মির্জা মহম্মদকেও আমি খুন করতে হুকুম করিনি কর্নেল। আমার হুকুম ছাড়াই মহম্মদি বেগ খুন করেছে।
তা হলে কার হুকুমে নবাব খুন হল?
ও বলছে, মিরন হুকুম দিয়েছিল।
কোথায় গেল মিরন?
তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। সে জাহাঙ্গিরাবাদের দিকে গেছে মনে হচ্ছে বেগমদের নিয়ে। আমি তালাশ করতে লোক পাঠিয়েছি।
আর নবাবের সঙ্গে যেসব বাঁদি বেগম কয়েদ ছিল, তারা কোথায় গেল?
নেয়ামত চাবি খুলে দিয়েছিল কামরার, তারা কোথায় পালিয়েছে কেউ জানে না
আচ্ছা, আপনি যান।
মিরজাফর চলে যেতেই মেজর কিলপ্যাট্রিক কাছে এল। ক্লাইভ ললে তুমি এখনই আর্মি নিয়ে চলে যাও কিলপ্যাট্রিক, আমি মিরনকে চাই। আই মাস্ট হ্যাভ হিম। তার সঙ্গে যেসব বেগম আছে, তাদের সকলকেই চাই–মরিয়ম বেগমকেও যেমন করে তোক আমার চাই-হারি আপ
*
কিন্তু ইতিহাসের যিনি দেবতা তিনি আপন খেয়ালেই আপন সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের কাজ চালিয়ে যান। তাই মানুষের ইতিহাস কেবল এই সৃষ্টি স্থিতি আর প্রলয়ের ইতিহাস। যে-হাতিয়াগড় নবাব-নিজামতের খেয়াল-খুশির হাতিয়ার হয়ে একদিন তছনছ হয়ে গিয়েছিল, আবার সেই হাতিয়াগড়ে ছোটমশাই ফিরে এসেছে।
খবরটা আগেই পৌঁছিয়ে গিয়েছিল বড় বউরানির মহলে। ছোটমশাই আবার সেই ঘাটে এসে নামল। নায়েব-গোমস্তা-প্রজা পাইক সবাই হাজির ছিল সেখানে। ছোটমশাই বজরা থেকে নামতেই গোকুল গিয়ে সামনে দাঁড়াল।
ছোটমশাই বললে–পালকি কই, পালকি আনিসনি?
দুর্গা ছোট বউরানিকে বললে–নামো গো, এবার নামতে হবে আমাদের
ছোট বউরানির যেন তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না। এতদিন পরে আবার হাতিয়াগড়ে ফিরতে পেরেছে। তা যেন তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবু যে ভালয় ভালয় আসা গেল তাও বুড়োেশিবের কল্যাণে। হাতিয়াগড়ে পৌঁছিয়েই বুড়োশিবের মন্দিরে গিয়ে পুজো দিতে হবে। অনেক দিনের মানত।
আস্তে আস্তে আলতা-পরা একটি পা বাড়িয়ে দিয়ে যাটে নামল ছোট বউরানি। দুর্গা পেছন পেছন নামল। ছোট বউরানি ঘোমটাটা ভাল করে কপালের উপর টেনে নামিয়ে দিলে। যেন বিয়ের পর নতুন বউ আসছে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে। আগে আগে চলতে লাগল ছোটমশাই। গোকুল মাথায় ছাতা ধরে চলেছে পেছনে পেছনে। জগা খাজাঞ্চিমশাই ঠিক তার পাশে।
ছোট বউরানি পালকির ভেতরে উঠতেই দরজা দুটো বন্ধ হয়ে গেল। তারপর চলতে লাগল ছাতিমতলার ঢিবির দিকে। ছাতিমতলার ঢিবি পেরিয়ে রাজবাড়ির অতিথিশালার বড় ফটক।
অতিথিশিলার বড় ফটকে মাধব ঢালি পাহারা দিচ্ছিল লাঠি হাতে করে। ছোটমশাই কাছে যেতেই দুই হাত জোড় করে মাথা নিচু করে পেম করলে।
ছোটমশাই বললে–কী রে, ভাল আছিস?
জগা খাজাঞ্চিমশাই বললে–আজ্ঞে, আপনি ছিলেন না, এতদিন সব খাঁ খাঁ করছিল
ছোটমশাই সেকথায় কান না দিয়ে যেমন চলছিল তেমনি চলতে লাগল। অতিথিশালাটা বাঁয়ে রেখে ডাইনের রাস্তা দিয়ে ভেতরবাড়ি যেতে হয়। ভেতরবাড়ির মুখেই পুকুর। শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটের বাঁ দিকেই বুড়োশিবের মন্দির। ছোট বউরানিকে বিয়ে করে আসার পর প্রথমে বুড়োশিবের মন্দিরে প্রণাম করতে হয়েছিল।
ছোটমশাই সেই দিকেই যাচ্ছিল। পালকি থেকে নেমে ছোট বউরানিও সেই দিকে যাচ্ছিল।
হঠাৎ ওপর থেকে বড় বউরানির গলা শোনা গেল–দুগ্যা
দুর্গা পেছন থেকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বললে–এই যে যাই বড় বউরানি—