হঠাৎ বজরাটায় যেন একটা দোলা লাগল। পেছন থেকে চিৎকার উঠল–ফিরিঙ্গিরা এসেছে, ফিরিঙ্গিরা এসেছে, জোরসে চালাও জোরসে
.
কিন্তু জোরে চালাতে বললেই নৌকা জোরে চলে না। ভেতরে জোর না থাকলে বাইরে সে দুর্বল হয়ে পড়বেই। নবাব আলিবর্দির সময় থেকেই নবাব-নিজামত ফতুর হয়ে গিয়েছে। যেটক জোর তখনও ছিল তাও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার সময়ে। জোর পাবে কোথা থেকে যে, নৌকো চলবে!
কেউ উৎসব করে ফতুর হয়ে যায়, কেউ ফতুর হয়ে যায় অভাবের চাপে। ১৭৫৭ সালের ২৬ জুলাই নবাব-নিজামত সত্যিই ফতুর হয়ে গিয়েছিল। টাকা নেই কোথাও। ফিরিঙ্গি কোম্পানির রসদ জোগাবার জন্যে আরও টাকা চাই। কিস্তিবন্দি হিসেবে লক্ষ লক্ষ টাকা শোধ করতে হবে কোম্পানির। পরের কিস্তিতে উনিশ লক্ষ টাকা চাই, কোত্থেকে আসবে। হুগলি, কৃষ্ণনগর, বর্ধমান সব জায়গায় চিঠি গেল টাকার জন্যে। রাজকর দাও।
আর এখান থেকে ক্লাইভ কেবল চিঠি লেখে-মরিয়ম বেগমকে আমার চাই—
মিরজাফর সাহেব মসনদে পাকা হয়ে বসে দেখলে, মালখানা নিঃশেষ। তার ওপর ক্লাইভ সাহেবের তাগাদা। জগৎশেঠজিও হাত উপুড় করে না।
মরালী তাগাদা দেয়–কই, খবর পেলে কিছু?
ক্লাইভ বলে–মেজর কিলপ্যাট্রিককে পাঠিয়েছি–আর একটু সবুর করো
খবর যায় মিরনের কাছে। ইতিহাসের তাগিদে যে-লোক ইন্ডিয়ায় এসেছিল সাত সাগর-তেরো নদী অতিক্রম করে, সে অমনি অমনি আসেনি। অমনি অমনি রাজ্যের উত্থানও হয় না, পতনও হয় না। যখন উত্থানের দরকার হয় তখনই একজন আকবর বাদশার আবির্ভাবের প্রয়োজন হয়, কিংবা একজন শিবাজির। আবার যখন পতনের দরকার হয় তখনই একজন রবার্ট ক্লাইভের প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে ওঠে। একজন গড়বার জন্যে উদয় হয়, আর একজন ভাঙবার জন্যে। প্রতিদিনের ইতিহাসেও একবার আলো, একবার অন্ধকার। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠা, আর রাত্রে ঘুমিয়ে পড়া। জোয়ার-ভাটার টানাপোড়েনে ইতিহাস তার নিজের রাস্তা নিজেই করে চলেছে। ইতিহাস বলছে, আমি উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ করি না, ধনী-নির্ধন বিচার করি না, জ্ঞানী-মূর্খ তারতম্য করি না। অনাদিকাল থেকে শুরু হয়েছে আমার যাত্রা। আমার কাছে মহারাজ অশোকও যা, তার রাজ্যের নির্জন কুটিরের নিঃস্ব প্রজাটিও তাই। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই তোমায় যেতে হবে, জায়গা করে দিতে হবে নতুনকে। সে অনেক দূর থেকে আসছে। তোমার গোরুর গাড়ি, তোমার নৌকোর যুগ শেষ হয়ে এসেছে। এবার তাদের দেশ থেকে আসছে স্টিম ইঞ্জিন, কলের জাহাজ, ছাপাখানা। আসছে ধান ভাঙার কল, কাপড় বোনার মিল। আসছে নোট ছাপানোর মেশিন, আসছে গান শোনানোর গ্রামোফোন, আসছে ছবি তোলার ক্যামেরা। এবার ওদের জোয়ার এসেছে, আর তোমাদের ভাটা। ওদের সঙ্গে তোমরা পারবে কেন?
তুমি কাঁদছ? তোমার বাংলা মুলুকের নবাব খুন হল বলে তুমি কাঁদছ? কিন্তু নবাবকে যদি আজ বাঁচিয়ে রাখি তত তোমাদের ভাটার কাল যে কাটবে না। তোমাদের গোরুর গাড়ি আর নৌকোর যুগ যে শেষ হবে না!
কে?
ভাঁটার দেশের নবাব মুখ তুলে চাইলে।
আমি মহম্মদি বেগ!
আমাকে তুমি খুন করতে এসেছ তো? কিন্তু আমি তো তেমন কোনও অন্যায় করিনি মহম্মদি বেগ। আমি যা কিছু অন্যায় করেছি, অত্যাচার করেছি, তার চেয়ে যে অনেক বেশি অন্যায় করেছে আমার পূর্বপুরুষরা, তারা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে, বাকি খাজনার দায়ে তাদের নরকযন্ত্রণা দিয়েছে, তাদের তো কেউ খুন করোনি তোমরা?
মহম্মদি বেগের হাতের ধারালো ছোরাটা ঝকঝক চকচক করে উঠল।
আর আমাকে খুন করেই কি তুমি দুনিয়ার অন্যায় বন্ধ করতে পারবে মহম্মদি বেগ! আমাকে খুন করে যাকে আনছ সে কি তোতামাদের ওপর অত্যাচার করবে না ভেবেছ? সে যদি আবার আমার মতো বাংলা মুলুকের প্রজাদের শোষণ করে, তাদের ঘরের বউদের ধরে নিয়ে হারেমে পোরে, যদি ধরে বেঁধে খ্রিস্টান করে, যদি তাদের আঙুল কেটে দেয়, তখন কি তাকেও খুন করতে পারবে তুমি মহম্মদি বেগ?
মহম্মদি বেগরা তো ইতিহাসের খিদমদগার মাত্র। এমনি করেই মহম্মদি বেগদের হাতে বারবার একজন খুন হয়েছে, শুধু আর-একজনের আবির্ভাব সহজ হবে বলে। ভাঁটার পর জোয়ারের টান তীব্র হবে বলে।
ক্লাইভ সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দিকে চেয়ে দেখছিল। মিরনের জাফরগঞ্জের হাবেলিতে একটা অন্ধকার ঘরের ভেতরে তখন যেন একটা পরিচ্ছেদ সমাপ্ত হল। সমাপ্ত হল একটা পতনের অধ্যায়। পৃর্ণচ্ছেদ পড়ল একটা জীবনের ওপর।
ক্লাইভ বললে–কিন্তু আমি তো হুকুম দিয়েছিলাম নবাবকে বাঁচিয়ে রাখতে
মিরজাফর সাহেব বললে–আমি কিছু জানতাম না কর্নেল, মিরন এই কাণ্ড করেছে–মহম্মদি বেগকে হুকুম দিয়েছিল নবাবকে খতম করে দিতে!
নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলার গলার কণ্ঠার ওপর একটা গর্ত দিয়ে তখনও গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। রক্তের ধারা গড়াতে গড়াতে চলেছে ঘরের কোণের একটা নর্দমার দিকে। মুখটা হাঁ হয়ে রয়েছে। চোখ দুটো স্থির হয়ে চেয়ে রয়েছে ক্লাইভের দিকে। একটু কাত হয়ে রয়েছে বাঁ দিকে। নবাবকে কুর্নিশ করবার সময় আমির-ওমরাহ যেমন মাথা কাত করত তেমনই ভঙ্গি। যেন ক্লাইভকে কুর্নিশ করছে নবাব। যেন নিঃশব্দে বলছে–সালাম আলেইকুম জনাব! সালাম তোমাকে