মিরজাফর সাহেব থামিয়ে দিলে। বললে–তুমি থামো উমিচাঁদ
সেকী, আমি থামব কেন?
জগৎশেঠ, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সবাই থামতে বললে–উমিচাঁদকে। মুনশি নবকৃষ্ণও উমিচাঁদকে চুপ করতে বললে। কিন্তু উমিচাঁদের তখন শুধু পাগল হতে বাকি। বললে–তুমি বলছ কী ছোকরা, আমি থামব? আমার কুড়ি লাখ টাকা খোয়া গেল, আর আমি চুপ করে থাকব?
*
দুর্গা আর ছোট বউরানি তখন পায়ে পায়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। নতুন জায়গা, জীবনে কখনও মুর্শিদাবাদে আসেনি। রাস্তার মানুষের সামনে কথা বলতেও ভয় হয়। হঠাৎ একটা বাড়ি দেখে মনে হল সেটা যেন হিন্দুর বাড়ি।
সামনের ফটকে ভিখু শেখ দাঁড়িয়ে ছিল। জেনানা দেখে একটু নরম সুরে বললে–কৌন?
দুর্গা জিজ্ঞেস করলে এটা কার বাড়ি গো পাহারাদার? হিন্দুর বাড়ি?
ভিখু শেখ বললে–হ্যাঁ, মহারাজ জগৎশেঠ বাহাদুরকা হাবেলি–
একটু অন্দরে যেতে পারব বাবা? আমরাও হিন্দু
আর ওদিকে নেয়ামত তখন পাশের কামরার চাবিটা খুলে ডাকলে–জাঁহাপনা
কে?
মির্জা মহম্মদ বুঝি সেই অন্ধকারের মধ্যেই মুখে তুলে চাইলে।
আমি নেয়ামত জাঁহাপনা।
তুমি কেন নেয়ামত? ওরা কোথায় গেল?
মাঝে মাঝে অন্ধকারও বুঝি কথা কয়। অন্ধকার যদি কথা কইতে পারে তো বুঝতে হবে খোদাতালাহ বলে সত্যিই কেউ আছে। যদি খোদাতালাহ বলে কেউ থাকে তো আমি তার কাছেই আমার আর্জি পেশ করছি আজ। আমি তো কারও কাছ থেকে আর কিছুই চাই না। আমার যা-কিছু ছিল সব তো ওরা কেড়ে নিয়েছে। তবু আমাকে কেন ওরা কয়েদ করে রেখেছে! আমার লুৎফাঁকে ওরা নিয়েছে, আমার মেয়েকে ওরা নিয়েছে, আমার মসনদও ওরা নিয়ে নিয়েছে। ওরা আমার চেহেল্-সুতুনে ঢুকে যা-কিছু আমার বলতে ছিল সব কেড়ে নিয়েছে। এবার আমাকে ওরা ছেড়ে দিকনা। আমি আমার জীবনটাকে নিয়ে যে এলোমেলো করে ব্যবহার করেছি তা আমি জানি। আমি যে কারও উপকার করিনি তাও আমি জানি।…কিন্তু…
জাঁহাপনা, আমি নেয়ামত, জাঁহাপনার খিদমদগার
না না নেয়ামত, আমি জানি তুমি নেয়ামত নও। আমি জানি আমি স্বপ্ন দেখছি। আমি জানি অন্ধকার কথা বলে। আমি জানি, আমি আমার মতিঝিলে শুয়ে নেই। আমি জানি, মিরদাউদ, মিরকাশিম আর মিরন আমায় কয়েদ করে রেখেছে। আমি জানি আমি জেগে আছি। আমি জানি আমার কেউ নেই। স্বপ্নে তুমি আমায় দেখা দিয়ো না নেয়ামত। আমাকে আশা দিয়ো না, আনন্দ দিয়ো না, আলো দেখিয়ো না।
এখানে কেউ নেই জাঁহাপনা, আপনি পালিয়ে যান, খিড়কির ফটক খুলে রেখেছি
আবার? আবার তুমি আমাকে অভয় দিচ্ছ? আমি তো বলেছি আমি হেরে গেছি, আমি লাবাগ থেকে পালিয়েছি। আমি তো স্বীকার করে নিয়েছি যে জীবন সত্য নয়, মৃত্যুই একমাত্র খাঁটি সত্য এই পৃথিবীতে। মৃত্যু যখন সত্য, মৃত্যুর আদেশ যখন সত্য, তখন পরাজয়কেই আমি চরম পরাভব বলে মেনে নিয়েছি। আর আমি কখনও বলব না যে, আমি বাঁচতে চাই, বলব না যে আমি মসনদ চাই। আমি তোমাদের সকলের সামনে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমি কখনও বলব না যে তোমাদের পৃথিবী আমাকে ধারণ করেছে, তোমাদের সূর্য আমাকে জ্যোতি দিয়েছে, তোমাদের বাতাস আমার নিশ্বাস জুগিয়েছে। একথাও আমি কখনও বলব না যে এই মহামনুষ্যলোকে আমি অক্ষয় অধিকার লাভ করে জন্মগ্রহণ করেছি। বলব না যে এই পৃথিবী আমাকে শান্তি দিয়েছে, আরাম দিয়েছে, গৌরব দিয়েছে; শুধু বলব, আমাকে এই বিরাট বিশাল পৃথিবীর এক কোণে শুধু একটুকরো জমি দাও, আমি সেখানে সকলের অগোচরে শুধু একটু মাথা গুঁজে থাকব।
কর্নেল, কর্নেল!
অনেক রাত্রে ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল কর্নেল ক্লাইভের।
কে?
কর্নেল, আমি কিলপ্যাট্রিক! নবাব খুন হয়ে গেছে।
খুন! মার্ডার! নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা?
ক্লাইভ তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠেছে।
কিন্তু আমি তো অর্ডার দিয়েছিলাম যে নবাবকে যেন কোনও পানিশমেন্ট এখন না দেওয়া হয়। আমি তার বিচার করব। কে মার্ডার করলে?
মহম্মদি বেগ।
সে কে?
কিলপ্যাট্রিক বললে–মিরনের লোক।
মিরন কোথায় এখন?
কিলপ্যাট্রিক বললে–এখনও তার কোনও ট্রেস নেই—
চলো, আমি যাচ্ছি। বলে ক্লাইভ উঠল। তারপর পোশাক পরে নিয়ে ঘরের বাইরে এল।
*
ওদিকে অশেষযাত্রার পথিক তখন নিঃসীম আকাশের দিকে চেয়ে শুধু একমনে প্রার্থনা করে চলেছে মরালী যেন মুর্শিদাবাদ থেকে দূরে চলে যেতে পারে ঠাকুর। দূরে চলে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। যে যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়।
পুব থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম থেকে উত্তরে, আবার উত্তর থেকে দক্ষিণে। এমনি মাসের পর মাস চলে গেছে। ছ’টা বজরা একবার জাহাঙ্গিরাবাদে গিয়ে কিছুদিন থামে, তারপর সেখানেই থাকে কিছুদিন। তারপর আবার নিরুদ্দেশ্যত্রা। সার সার বজরাগুলো চলে নদীর ওপর দিয়ে।
মিরন যেন কিছুতেই আর ভরসা পায় না। মেজর কিলপ্যাট্রিকের দল তার পেছনে পেছনে ঘোরে। কলকাতা থেকে কর্নেল ক্লাইভ হুকুম দিয়েছে, যেমন করে থোক মিরনকে ধরে আনা চাই। শুধু মিরন নয়। মিরনের সঙ্গে যে-বেগমরা আছে তাদেরও।
সেদিন হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। বৃষ্টি এলে কান্তর বড় ভাল লাগে। তখন বড় নিবিড় করে নিজেকে নিজের মধ্যে পায়। তখন একমনে বলে মরালী যেন মুর্শিদাবাদ থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে ঠাকুর। দূরে চলে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। সে যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়