ক্লাইভ বললে–বলছ কী তুমি?
মরালী বললে–কতটুকু আর বলেছি তার সম্বন্ধে! কতটুকু আর জানো তোমরা! কতটুকুই বা তোমরা বুঝতে পারবে। তোমরা তো কেবল যুদ্ধ করতেই শিখেছ, ভালবাসতে তো শেখোনি।
বলতে বলতে মরালী যেন ভেঙে পড়ল। তারপর সামলে নিয়ে বলতে লাগল–ওগো, তোমরা ফিরিঙ্গি, তোমরা বুঝতে পারবে না তাকে। তোমাদের বোঝাই এমন ক্ষমতা আমার নেই–তুমি তাকে যেমন করে পারো আমার কাছে এনে দাও
কিন্তু তাকে এনে দিলে তুমি কী করবে?
কী করব জানি না। তাকে তুমি যেমন করে পারো নিয়ে এসো।
ক্লাইভ বললে–কিন্তু তাকে তো আর তুমি বিয়ে করতে পারবে না। তুমি তো মুসলমান, আর সে তো হিন্দু তোমাকে কি আর হিন্দুরা ঘরে নেবে?
মরালী বললে–আমার কোনও জাতই নেই আর। আমি হিন্দু ছিলাম, তারপর মুসলমান হলাম, এবার না-হয় খ্রিস্টানই হব–
উদ্ধব দাসের লেখায় পাচ্ছি, এরপর মেজর কিলপ্যাট্রিক মরালীকে সেদিন সেই দুর্যোগের মধ্যে লুকিয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। কেউ জানতে পারেনি, কেউ সন্দেহও করেনি, কেউ প্রশ্নও করেনি। সবাই জেনেছিল ক্লাইভ সাহেব নবাবের হারেম থেকে, নবাবের মালখানা থেকে কিছু দামি জিনিস পেয়েছে, সিন্দুকে ভরতি করে তাই কলকাতায় পাঠাচ্ছে।
সিন্দুকটা গিয়ে উঠল বজরায়।
আর সেই বজরায় গিয়ে উঠল উদ্ধব দাস।
*
এরপর দমদম! দমদম হাউস। মরালী আর উদ্ধব দাস চলে যাবার ক’দিন পরেই ফিরিঙ্গি ফৌজ মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে এসেছিল। কিন্তু যখন চেহেল-সুতুনে দরবার চলেছে, মিরজাফর আলি সাহেব ক্লাইভকে ভেট দিয়ে খোশামোদ করছে, তখন ওদিকে আর-এক কাণ্ড!
নেয়ামত মতিঝিলের পুরনো খিদমদগার। সে একদিন নবাব মির্জা মহম্মদের খেদমত করেছে। তার এ-দৃশ্য দেখে মনে বুঝি খুব কষ্ট হল। এই নবাবেরই নিমক খেয়েছে এতদিন, আবার এই নবাবকেই কয়েদ থাকতে হচ্ছে, এটা তার সহ্য হল না। মিরন সাহেব খুব হুঁশিয়ার করে দিয়ে গিয়েছিল তাকে। ঠিকমতো যেন পাহারা দেয় আসামিদের। পরপর তিনটে কামরা। একটা কামরায় নবাব, আর পাশের কামরা দুটোতে বাদিরা। আরও কষ্ট হয়েছিল তার নবাবের বেগম লুৎফুন্নিসা বিবির দশা দেখে। তাকে জলুসের মাঝপথ থেকেই মিরন সাহেব পাকড়ে নিয়ে গিয়ে মতিঝিলে তুলেছিল। তারপর তাকে কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছিল, তার হদিস নেই।
কাছাকাছি যখন কেউ কোথাও নেই, তখন নেয়ামত একটা কামরার চাবি খুললে। ডাকলে বিবিজি
মরালী ভেতরে বসে ভাবছিল কী করবে। হঠাৎ দরজা খুলতে দেখে দরজার কাছে এল।
কে?
নেয়ামত বললে–বিবিজি, আমি নেয়ামত, আপনি বাইরে বেরিয়ে যান, কেউ কোথাও নেই, খিড়কির ফটক খুলে দিয়েছি, পালিয়ে যান
মরালী এরপর আর দ্বিরুক্তি করেনি। সোজা খিড়কি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল।
এরপর পাশের কামরা। সেকামরার সামনে গিয়েও ওইরকম।
বিবিজি, আমি নেয়ামত, আপনারা বেরিয়ে যান, কেউ কোথাও নেই, খিড়কির ফটক খুলে দিয়েছি, আপনারা পালিয়ে যান–শিগগির–
দুর্গা নেয়ামতকে দরজা খুলতে দেখে চমকে গিয়েছিল। কিন্তু কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। এ আবার কে?
কিন্তু নেয়ামত তখন নিজের কাজ সেরে নিয়ে পাশের কামরায় চলে গেছে।
ছোট বউরানি বললেও কে রে দুগ্যা? কী বলে গেল?
দুর্গা বললে–আর দেরি নয় ছোট বউরানি, চলো খিড়কি দিয়ে পালাই
কোথায় পালাব রে?
চলো চলো ছোট বউরানি, আগে এখেন থেকে তো পালাই, তারপরে যে-চুলোয় যাই, তখন দেখা যাবে।
বলে আর পঁড়ায়নি সেখানে। অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে একেবারে সোজা খিড়কির দিকে চলে গিয়েছিল। খিড়কির দিক থেকে একেবারে রাস্তা। রাস্তায় তখন লোকে লোকারণ্য। অনেক মানুষের ভিড়। তখন সারা শহরে গোলমাল। সব লোক দরবার দেখবার জন্যে রাস্তায় জড়ো হয়েছিল। অনেকেই দরবারে ঢুকেছে। কিন্তু ঢুকতেও পারেনি অনেকে। ফিরিঙ্গি ফৌজের লোকরা রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে। তারা নতুন শহরে এসেছে। এ-শহর এখন তাদের। তাদের শরিকানা আছে এ-শহরের সম্পত্তির ওপর।
চেহেলসূতুনের দরবারে তখন মিরজাফর ডাকছে-মরিয়ম বেগম
মরিয়ম বেগম হাজির হচ্ছে না।
মিরজাফর আলি সাহেব আবার একবার চিৎকার করে উঠল–মরিয়ম বেগম।
চুক্তি অনুসারে ক্লাইভ সাহেব পেয়েছে কুড়ি লক্ষ আশি হাজার টাকা। দশ লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা ওয়াটস। পাঁচ লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা মেজর কিলপ্যাট্রিক। পাঁচ লক্ষ টাকা ওয়াল ম্যানিংহাম আর বিচার প্রত্যেকে দু’লক্ষ আশি হাজার টাকা। কাউন্সিলের ছ’জন মেম্বর প্রত্যেকে এক লক্ষ টাকা। টাকার ছড়াছড়ি।
হঠাৎ উমিচাঁদ দাঁড়িয়ে উঠল–আমি? আমার টাকা কই? আমার ভাগ?
ক্লাইভ সাহেব এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। বললে–তোমার কীসের ভাগ উমিচাঁদ?
সেকী সাহেব, আমি যে চুক্তিতে সই করলুম। আমার কুড়ি লাখ টাকা পাবার কথা! তোমাদের সঙ্গে যে আমার রফা হল?
এই তো কনট্রাক্ট, এতে তো তোমার নাম নেই।
উমিচাঁদ কাগজখানার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখে চেঁচিয়ে উঠল–কিন্তু সে লাল কাগজখানা কোথায়? আমি তো লাল কাগজে সই করেছি–এটা তো সাদা–এটা জাল জাল–
ক্লাইভের মুখখানা গম্ভীর হয়ে উঠল।
এটা যদি জাল তো আসল কোনটা?
আসলটা তোমরা লুকিয়ে ফেলেছ, ছিঁড়ে ফেলেছ, আমায় তোমরা ফাঁকি দিচ্ছ, আমায় ঠকাচ্ছ—
কিন্তু উমিচাঁদ জানত না যে, সেদিন সাত সমুদ্র-তেরো নদীর পার থেকে যারা এতদূরে এসে এ-দেশের সিংহাসন দখল করতে পারে তারা জাতব্যবসাদার উমিচাঁদের চেয়েও বড় ব্যাবসাদার। ব্যবসায় সততা বলে কিছু থাকতে নেই, থাকলে তা আর ব্যবসা নয়। উমিচাঁদ নিজেও তা ভাল করে জানত। কিন্তু কুড়ি লাখ টাকার লোভে তখন বোধহয় সেকথা ভুলে গিয়েছিল।