প্রথমে ক্লাইভ আপত্তি করেছিল। বলেছিল–তুমি কেন খ্রিস্টান হতে যাবে?
মরালী বলেছিল–একবার যখন মুসলমান হয়েছি, তখন আর খ্রিস্টান হতেই বা আপত্তি কী?
যদি কেউ তোমার আপনার লোক আপত্তি করে?
আপনার লোক আমার কে আছে?
এই পোয়েট?
উদ্ধব দাস পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। উদ্ধব দাস সেই মুর্শিদাবাদ থেকেই সাহেবের সঙ্গে আছে। সেই–মনসুরগদিতে যখন তাকে নিয়ে গিয়েছিল, তখন থেকে। কত কাণ্ডই ঘটল তারপর। কত দুর্ঘটনা আর কত দুর্যোগই মাথার ওপর দিয়ে গেল মরালীর হাতিয়াগড় থেকে খবর এল নফর শোভারাম বিশ্বাস মারা গেছে। মরালী খবরটা শুনল। কিন্তু কাদল না।
শুধু বললে–এবার আমি কোথায় যাব?
তোমার হাজব্যান্ড এই পোয়েট, তারই সঙ্গে যাও
তারপর উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে সাহেব বললে–পোয়েট, তুমি তোমার ওয়াইফকে নেবে? তোমার ওয়াইফ মুসলমান হয়েছে বলে তাকে নিতে তোমার আপত্তি আছে?
উদ্ধব দাস বললে–আমার কোনও বিকার নেই প্রভু, আমার কাছে সবই সমান। হিন্দু খ্রিস্টান মোছলমান ভেদাভেদ নাই।
হঠাৎ মরালী বলে–না, আমার আপত্তি আছে
ক্লাইভ জিজ্ঞেস করলে–তোমার আপত্তি কীসে?
মরালী বললে–আমি নষ্ট
উদ্ধব দাস বললে–মানুষের দেহ নষ্ট হলে মানুষ নষ্ট হয় না গো দেহটা তো খোলস, আত্মায় তো দাগ লাগে না। কী বলেন প্রভু? আত্মার তো লিঙ্গ নাই, মন নাই, অহংকারও নাই, আত্মা তো তোমার নষ্ট হয় নাই!
মরালীর তবু সেই এক কথা। বললেন, না আমি নষ্ট
তখন আর কোনও উপায়ই ছিল না। সাহেব বললে–তা হলে তুমি দমদমেতেই থাকো–
তা তা-ই ঠিক রইল। মরালী বললে–কিন্তু তুমি যে কথা দিয়েছিলে, সকলকে ছাড়িয়ে দেবে! রানিবিবিকে ছাড়িয়ে দেবে, নবাবকে ছাড়িয়ে দেবে, মতিঝিলের সেই মরিয়ম বেগমকেও ছাড়িয়ে এনে দেবে!
ক্লাইভ বললে–আজই চেহেল্-সুতুনে দরবার আছে, আজই দরবারে আমি মিরজাফর আলিকে মসনদে বসিয়ে দেব, তারপর নবাবকে ছেড়ে দিতে হুকুম দিয়ে দেব।
আর হাতিয়াগড়ের ছোট রানিবিবি?
তাদেরও খোঁজ নিয়েছি। মিরন সাহেবের বাড়িতে তাদের রাখা হয়েছিল, কিন্তু সেখান থেকে তারা নিরুদ্দেশ। নেয়ামত বলে একজন নবাবের খিদমদগার ছিল, সে তোমার ঘরের দরজা যেমন খুলে দিয়েছিল, হাতিয়াগড়ের রানিবিবির দরজাও তেমনি খুলে দিয়েছিল, নবাবের ঘরের দরজাও তেমনি খুলে দিয়েছিল। এখন সেখানে মহম্মদি বেগ বলে একজন পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু তারপর রানিবিবিদের আর কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না–
তুমি তা হলে নবাবকে ছাড়বার হুকুম দিয়ে দাওনা!
দেব, দরবারের পর আমি চেহেল্-সুতুনে ঢুকব। সেখানকার মালখানায় কী আছে দেখি, তারপর নবাবের সম্বন্ধে হুকুম দেব। আমি মিরজাফরকে বলে দিয়েছি যেন আমার পারমিশন না নিয়ে নবারে সম্বন্ধে কিছু না করা হয়।
মরালী বললে–কিন্তু আমি কলকাতায় চলে গেলে কি সব কথা মনে থাকবে?
ক্লাইভ সাহেব বলেছিল–নিশ্চয়ই মনে থাকবে, আমার সব কথা মনে থাকে। সব কথা মনে থাকাটাই তো আমার রোগ। আমি কিছু ভুলতে পারি না।
আর সেই, তার কী হবে?
তুমি সেই মতিঝিলের মরিয়ম বেগমের কথা বলছ তো? হাতিয়াগড়ের সেই ছোটমশাই আমার কাছে এসেছিল। তার এখনও ধারণা মতিঝিলে যে মরিয়ম বেগম কয়েদ হয়ে আছে সে তারই ওয়াইফ। আমি তার সঙ্গে আমার মেজর কিলপ্যাট্রিককে পাঠিয়েছিলাম মতিঝিলে। কিন্তু মরিয়ম বেগম সেখানে নেই–
মরালী চমকে উঠল। বললে–সেকী? কী বলছ তুমি? কোথায় গেল সে?
ক্লাইভ সাহেব বললে–বুঝতে পারছি না। শুনলাম, নানিবেগম, আমিনা বেগম, ময়মানা বেগম, ঘসেটি বেগম, লুৎফুন্নিসা বেগম, তাদের সকলের সঙ্গে মরিয়ম বেগমকেও কোথায় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে–
কে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে?
বোধহয় মিরন। মিরজাফরের ছেলে।
মরালী বললে–তা মিরনকে তুমি গ্রেফতার করতে পারছ না? তোমার সেপাই রয়েছে, ফৌজ রয়েছে, তোমার কামান রয়েছে, বন্দুক রয়েছে, তাকে তুমি জব্দ করতে পারছ না? তা হলে তুমি কীসের কর্নেল, কীসের ফিরিঙ্গি?
ক্লাইভ হাসল। বললে–আমি খোঁজ নিয়েছি তার, কিন্তু সে পালিয়েছে—
পালিয়েছে মানে? মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়েছে?
হ্যাঁ।
মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়েছে বলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা? তা হলে নবাব মির্জা মহম্মদকে খুঁজে পাওয়া গেল কী করে? সে কি আকাশে উড়ে গেল? তোমরা খোঁজ নেবে না সে বেগমদের কোথায় সরিয়ে নিয়ে গেল? তাকে যে আমার খুঁজে পেতেই হবে!
ক্লাইভ বললে–আমি তো তোমাকে কথা দিয়েছি তাকে খুঁজে বার করব–
কবে? কবে খুঁজে বার করবে?
ক্লাইভ বললে–এখনই। এখনই আমি মেজরকে ডেকে পাঠাচ্ছি। তাকে তোমার সামনেই বলব সেই বেগমদের খুঁজে বার করতে। তাকেই বলব তোমাকে নিরাপদে কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে।
তাকে খুঁজে না পেলে আমি যাব না। আমি কিছুতেই যাব না এখান থেকে।
ক্লাইভ বুঝিয়ে বললে–তুমি যাও, তোমার ভালর জন্যেই বলছি তুমি যাও এখান থেকে, তুমি এখানে থাকলে বরং তাকে খুঁজে বার করতে অসুবিধে হবে।
কিন্তু তাকে না খুঁজে পেলে আমি যাব না।
ক্লাইভ অবাক হয়ে গেল। বললে–কিন্তু সে তোমার কে?
মরালী বললে–সে?
বলে হাসল খানিক। পাগলের হাসির মতো সে-হাসিটা শোনাল ক্লাইভের কানে। বললে–সে যে কে তা তোমরা বুঝবে কী করে? তোমার জন্যে কেউ কখনও নিজের প্রাণ দিতে গিয়েছে? কেউ কখনও তোমার জন্যে নিজের ক্ষতি হাসিমুখে সহ্য করেছে?