আর একটা চিঠিতে লিখেছিল–আবার আমার সেই অসুখটা হয়েছে পোয়েট, আবার বিছানায় গিয়ে ঘুমোলেই সেই লোকটা আসে। সেই সাকসেস। এসে আমাকে তাস দেখায়। সেই কুইন অব স্পেক্স। সেই ইস্কাবনের বিবি। আবার সেই বিষ খেতে হয়। আমি বোধহয় আর বেশিদিন বাঁচব না শোয়েট..
সত্যিই আর বেশিদিন বাঁচেনি সাহেব। পরে তার বউয়ের চিঠিতে সে কাহিনী জানতে পেরেছিল উদ্ধব দাস। একদিন তাস খেলতে বসেছিল সাহেব। অনেকদিন ধরেই ঘুম হচ্ছিল না রাত্রে। ইন্ডিয়াতে যে-লোক ব্রিটিশ এম্পায়ার প্রতিষ্ঠা করলে তারও কিনা ঘুম হত না অশান্তিতে। অর্থের অশান্তি, খ্যাতির অশান্তি, সাকসেসের অশান্তি। সেই অশান্তিই যেন রাত্রে ঘরে ঢুকত।
কে? কে? কে তুমি? সাহেব গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠত ঘুমের মধ্যেই।
লোকটা বলত–আমি সাকসেস
কিন্তু কী চাই তোমার? কেন আসো আমার কাছে?
এটা চিনতে পারো?
সেই তাস। সেই ইস্কাবনের বিবি। সেই কুইন অব স্পেডস!
আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠত সাহেব! তখন পেগি পাশের ঘর থেকে দৌড়ে আসত। এসে সেই ঘুমের ওষুধটা এক দাগ খাইয়ে দিত। সেই বিষ!
একবার ক্লাইভ সাহেবের বউ লিখেছিল–এই মেরী বেগম কে? রবার্ট মেরী বেগমের কথা প্রায়ই বলে। রবার্ট ইন্ডিয়ার যত লোকের সঙ্গে মিশেছে তাদের কারও নাম বিশেষ বলে, কেবল মেরী বেগমের নাম করে, তোমার নাম করে, আর কেবল আর-একজনের নাম করে। তার নাম কান্ত সরকার। কান্ত সরকার কে? হু ইজ হি?
এইরকম কত চিঠি লিখেছে ক্লাইভ সাহেবের বউ। একবার লিখেছিল–রবার্ট বলে, আমি গিয়েছিলাম ইন্ডিয়া কনকার করতে, মেরী বেগম আমাকেই কনকার করে নিয়েছে। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাকে আমি হারিয়েছি, কিন্তু মেরী বেগম আমাকেই হারিয়ে দিয়েছে।
সত্যিই, মেরী বেগম যে এমন করে সবাইকে হারিয়ে দেবে তা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির নগণ্য, নফর শোভারাম বিশ্বাসের নগণ্যতর একটা মেয়ে যে এমন করে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সব সম্প্রদায়ের লোককে হারিয়ে দেবে তা শেষপর্যন্ত কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি সেদিন। ক্লাইভ সাহেব মাদ্রাজে কাটিয়েছে, বেঙ্গলে কাটিয়েছে, আরও কত জায়গায় কত দেশে কত লোকের সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশেছে, কিন্তু এমন করে কখনও হেরে যায়নি। ক্লাইভ সাহেব নিজে দু’বার আত্মহত্যা করতে গেছে, দু’বারই পারেনি। কিন্তু তা বলে এমন করে মৃত্যু?
মেরী বেগম বলেছিল-মরতে আমি ভয় পাই না সাহেব
ক্লাইভ সাহেব বলেছিল-মরতে আমিও ভয় পাই না। কিন্তু মরতে পারি কই?
মেরী বেগম বলেছিল–মরবার সাহস চাই, সকলের তো সে-সাহস থাকে না
ক্লাইভ বলেছিল আমার সাহস নেই বলতে চাও?
খুন করার সাহস তোমার আছে, মরবার সাহস নেই।
ক্লাইভ বলেছিল–আমিই কি তোমার নবাবকে খুন করেছি বলতে চাও?
তুমি খুন করেছ না তো কে খুন করেছে?
সেকী? আমি কখন খুন করতে গেলাম! সে তো মিরন করেছে। আমি তো তোমাকে কথা দিয়েছিলুম তোমার নবাবকে আমি বাঁচিয়ে দেব। শুধু নবাবকে একলা কেন, তোমার রানিবিবিকেও বাঁচিয়ে দেব, তোমার কান্তকেও বাঁচিয়ে দেব।
সত্যিই কথা দিয়েছিল ক্লাইভ! কিন্তু সেকথা শেষ পর্যন্ত রাখতে পারেনি। রাখতে না-পারার জন্যে দুঃখও ছিল প্রচণ্ড। বলতে গেলে কাউকেই বাঁচাতে পারেনি সাহেব। শেষকালে একদিন ইন্ডিয়া ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গিয়েছিল। বহুদিন পরে দেশে ফিরে গিয়েও হয়তো শান্তি পায়নি। তারপর একদিন তাস খেলতে বসেছিল নিজের বাড়িতে। খেলতে খেলতে হঠাৎ একটা তাস পেয়েই সাহেব উঠে দাঁড়াল।
ক্লাইভের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে–কী হল, উঠলে যে? ক্লা
ইভ সেকথার উত্তর না দিয়ে ঘর ছেড়ে পাশের ঘরে চলে গেল।
কী হল? কোথায় যাচ্ছ?
অনেক জন্ম দেখেছে ক্লাইভ, অনেক মৃত্যুও দেখেছে। অনেক উপিন দেখেছে, অনেক পতন। অনেক শুরু দেখেছে, অনেক শেষ। কাজ করেছে সারা জীবন, কাজ করতে করতে গ্রন্থি পড়েছে। আবার সেই গ্রন্থি নিয়ে অনেক কাজ বেড়েছে। সেটা খুলতে ছিঁড়তে অনেক টানাটানি করেছে। তাতে সম্মানের চেয়ে বদনামই হয়েছে বেশি। দেশের লোকই বদনাম দিয়েছে। তাকে জাতিচ্যুত করেছে, চোর বলেছে, গালাগালি দিয়েছে, একঘরে করেছে…
কী হল? কোথায় যাচ্ছ তুমি?
পাশের ঘরে গিয়ে সেদিন বৃদ্ধ ক্লাইভ সে-ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। পেগি ক্লাইভের কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে! কী হল? দরজা বন্ধ করলে কেন?
হঠাৎ..
কিন্তু সে কথা এখন থাক। যে-মানুষ একদিন পৃথিবীর কোনও মানুষের প্রীতি পায়নি, কোনও মানুষের সম্মান পায়নি, কোনও দেশের সুবিচার পায়নি, তার জীবনটা ব্যর্থ হয় হোক, তার জীবনের ব্যর্থতাটাও মিথ্যে হয় হোক, কিন্তু তার জীবনের ব্যর্থতার বেদনাটা অন্তত সত্য হয়ে উঠুক, সেই বেদনার বহ্নিশিখায় বেগম মেরী বিশ্বাস’কাব্যও পবিত্র হয়ে উঠুক। উদ্ধব দাসের লেখার প্রতি ছত্রে সেই বেদনা প্রমূর্ত হয়ে উঠেছে দেখলাম।
কিন্তু না, সেকথা সত্যিই এখন থাক। কারণ তার আগে বেগম মেরী বিশ্বাসের কথা বলতে হবে, মরিয়ম বেগমের কথা বলতে হবে। মেরী বেগমের কথা বলতে হবে। মরালীর কথা বলতে হবে। মরালীর ব্যর্থতার বেদনার কথা না বললে–যে ক্লাইভের ব্যর্থতার বেদনা নিরর্থক হয়ে যাবে!
*
মেরী বেগম।
ওই ওপাশে ছিল একটা গির্জা। যেদিন মরালী এখানে এল সেদিনই চলে গিয়েছিল গির্জায়।