চারদিকে অলিন্দের ফোকরে ফোকরে কয়েকটা পায়রা তখন বকবকম শব্দ করে ডেকে উঠছিল। ক’দিন কেউ নেই চেহেলসূতুনে, ক’দিন ধরে রান্না হয়নি বাবুর্চিখানায়, ঝাট পড়েনি দৌলতখানায়, বারবাগে। কদিন ধরে ভিস্তিখানায় জল তোলা হয়নি, ধোবিখানায় কাপড় কাঁচা হয়নি। সমস্ত চেহেল্-সুতুনটা যেন হাহাকারে খাঁ খাঁ করছে। বুড়ো সারাফত আলি বেগমদের আরক খাইয়েও যা করতে পারেনি, ক্লাইভ সাহেব সাতসমুদ্র-তেরোনদী পেরিয়ে এসে বিশ্বাসঘাতকতার রসদ জুগিয়ে যেন ন’ঘণ্টার লড়াইতেই তাই-ই করে ফেলেছে।
একে একে সব দেখা হল। খোজা সর্দার পিরালি খাঁ পাকা খিদমদগার। বেগমদের মহলগুলো দেখালে, ভুলভুলাইয়া দেখালে। কোথায় কোন মসজিদে বেগমরা নমাজ পড়ত তাও দেখালে, কোথায় নবাব সুজা-উ-দ্দিন বেগমদের নিয়ে দাবা খেলতেন তাও দেখালে। এক-একটা করে জায়গা দেখায় আর তাজ্জব হয়ে যায় মুনশি রামচাঁদ, মুনশি নবকৃষ্ণ, ওয়াটস্ আর কর্নেল ক্লাইভ।
সেদিন নবাবের খাজাঞ্চিখানায় পাওয়া গিয়েছিল এক কোটি ছিয়াত্তর লাখ রুপোর টাকা, বত্রিশ লাখ সোনার টাকা, দুই সিন্দুক ভরতি সোনার পাত, চার সিন্দুক ভরতি হিরে পান্না মুক্তো এইসব। আর দুটো ছোট সিন্দুক ভরতি শুধু জেবর–শুধু গয়না। বাংলা মুলুকের মাজমুনদের রক্ত নিংড়ে নিংড়ে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ’র আমল থেকে নবাব-নিজামতে যা-কিছু জমেছিল সবকিছুর হিসেব হল সেদিন।
কিন্তু যেটা হিসেব হল না সেটা ছিল নানিবেগমের মালখানায়। সেখানে কেউ ঢুকতে পেল না। বড় দুর্গম সে-জায়গাটা। সেখানে বাতাস বন্ধ, আকাশ সংকীর্ণ, আর অন্ধকার সেখানে বড় সজীব। এখানে কেউ এসো না। যে আসবে সে প্রাণ নিয়ে ফিরবে, কিন্তু পরমায়ু নিয়ে ফিরতে পারবে না।
মুনশি রামচাঁদ ক্লাইভের এক নম্বর মুনশি। কিন্তু মুনশি নবকৃষ্ণ উমিচাঁদ সাহেবের দেওয়া লোক। ক্লাইভ সাহেবের আরও বেশি পেয়ারের লোক।
মুনশির চোখ দুটো প্রথমে সে-অন্ধকার সহ্য করতে পারেনি। মালখানার সিন্দুকগুলো খুলতেই চোখে ধাঁধা লেগে গেল।
খোজা সর্দার পিরালি খাঁ ধরে ফেললে তাই রক্ষে। নইলে পড়েই যাচ্ছিল।
ক্লাইভও উঁকি মেরে দেখলে হোয়াট ইজ দিস? এগুলো কী?
মুনশি বললে–সোনা হুজুর, গোন্ড! পিয়োর গোন্ড
ক্লাইভ বললে–এত?
মুনশি নবকৃষ্ণ বললে–এত কোথায় হুজুর, এ তো সামান্য
এসব কী করে নেব?
মুনশি রামচাঁদকে সঙ্গে করে আনা উচিত হয়নি। তার চোখ দুটোও যেন গোল হয়ে গেছে। এখানে এত সম্পত্তি আছে, তা আগে জানলে মুনশি নবকৃষ্ণ একনম্বর মুনশিকে আর সঙ্গে করে আনত না। তাকেও ভাগ দিতে হবে।
পিরালি খাঁ হাত দিয়ে সোনার পাতগুলো তুলতে যাচ্ছিল। ভারী জিনিস সব। পিরালি খাঁ নিজেও কখনও এসব দেখেনি। এসবের কল্পনা করতেও শেখেনি। শুধু জেনে এসেছে নবাব মানেই খোদাতালাহ। শুধু জেনে এসেছে নবাববাদশা-বেগমদের কোনওদিন কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না, কেউ তাদের কাছে কোনও জবাবদিহি চাইতে পারবে না। তারা অবাঙমানসোগোচর আল্লা, আমাদের নাগালের বাইরে।
ক্লাইভ বললে–এসব কী করে নেব মুনশি?
রামচাঁদ বললে–ওদের বললেই ওরা সব তোরঙ্গ ভরতি করে পাঠিয়ে দেবে কলকাতায়
না না না, হুজুর!
মুনশি নবকৃষ্ণর মাথায় কূটবুদ্ধিটা খুব খেলে। টপ করে বললে–না না না হুজুর, এসব ওদের দেখালে ওরাও ভাগ চাইবে হুজুর, তার চেয়ে আমরা তিনজনে ভাগ করে নিই–
তা সেই ব্যবস্থাই হল। কেউ জানল না নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার চেহেল্-সুতুনের গোপন মালখানায় কত সম্পত্তি ছিল, কেউ দেখতেও পেলে না। যখন বেরিয়ে এল তিনজন তখন বাইরে ওয়াটস্ পঁাড়িয়ে ছিল।
ওয়াটস জিজ্ঞেস করলে–মালখানায় কী ছিল?
মুনশি নবকৃষ্ণ বললে–কিছু ছিল না সাহেব, নবাববেটা সব সরিয়ে ফেলেছে রাতারাতি
কিন্তু বহুদিন পরে এই উদ্ধব দাসই লিখেছে মুনশি নবকৃষ্ণ আর মুনশি রামচাঁদের কথা। মুনশি রামচাঁদ পরে যখন আন্দুল রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠা করে, তখন তার মৃত্যুর সময়ে যে সম্পত্তি রেখে গিয়েছিল তার মধ্যে ছিল নগদে আর কাগজে বাহাত্তর লক্ষ টাকা, হিরে-জহরতে বিশ লাখ, আঠারো লাখ টাকার জমিদারি আর চারশো কলসি, তার মধ্যে আশিটা সোনার আর বাকি সব রুপোর। মোট সওয়া কোটি টাকার সম্পত্তি।
আর মুনশি নবকৃষ্ণ?
মাতৃশ্রাদ্ধে যিনি বারো লাখ টাকা খরচ করেছেন, তাঁর খ্যাতি আজকালকার আমরাও জানি। উদ্ধব দাসের ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্য পড়তে পড়তেও তার প্রমাণ পেলাম।
কিন্তু ক্লাইভ সাহেব, যে ছ’টাকা মাইনের রাইটারের চাকরি নিয়ে ইন্ডিয়ায় এসে দেশে ফিরে গেল ইংলন্ডের সবচেয়ে বড়লোক হয়ে, তার কথাও লিখতে বাকি রাখেনি উদ্ধব দাস। দেশে ফিরে গিয়েও পোয়েটকে চিঠি লিখেছে কর্নেল সাহেব। ছ’মাসে একটা চিঠি আসত। বড়লোক সাহেব, কিন্তু ইন্ডিয়ার গরিব পোয়েটকে হয়তো ভুলতে পারেনি। বউ পেগির কথা লিখত, ছেলে-মেয়েদের কথা লিখত। আর লিখত নিজের কথা। দুঃখ করে অনেক কথা লিখত সাহেব। লিখত, ইন্ডিয়ায় যেক’বছর কাটিয়েছে সেই ক’বছরই বড় সুখের সময় গেছে। তার জীবনে কোনও সুখ নেই আর। দেশের লোক তার নামে মামলা করেছে। তার নামে কলঙ্ক রটিয়েছে, তাকে চোর বলে রাজার দরবারে নালিশ করেছে।
একটা চিঠিতে লিখেছিল–তোমার মতো যদি গরিব হতাম পোয়েট, তোমার মতো যদি আনসাকসেসফুল হতাম, তা হলেই হয়তো ভাল হত। কেন আমি বেঙ্গল কনকার করতে গেলাম, কেন আমি সাকসেসফুল হলাম!