মরিয়ম বেগম! মরিয়ম বেগম।
মুর্শিদাবাদ থেকে অনেক দূরে মিরনের বজরাটা তখন আরও জোরে ছুটে চলেছে। আরও বেগে। এতক্ষণ ছ’টা বজরা বেগমদের নিয়ে বোধহয় ভগবানগোলার দিকে পৌঁছে গেছে। জোরসে চালাও মাঝি, জোরসে চালাও ।
কিন্তু অশেষযাত্রার পথিক তখন একমনে প্রার্থনা করে চলেছে–তুমি তাকে সুখী করো ঈশ্বর। সে যেন মুর্শিদাবাদের পাপ আর পঙ্কিলতা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। সে যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়।
চেহেল্-সুতুনের আম-দরবারে মিরজাফর সাহেব তখন শেষবারের মতো ডাকলে–মরিয়ম বেগম!
৩. শান্তি পর্ব
এই শেষ। শেষ, কিন্তু শুরুও বটে। ইতিহাসের এক অধ্যায়ের শেষ, আর এক অধ্যায়ের শুরু। মানুষের জন্ম আছে, আবার মৃত্যুও আছে। জন্ম-মৃত্যুর টানাপোড়েনে যেমন এক অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনই শুরু আর শেষের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অশেষ ইতিহাস। সেই অশেষ ইতিহাসের একটা ভগ্নাংশ নিয়ে উদ্ধব দাস লিখে গিয়েছেন এই বেগম মেরী বিশ্বাস। শেষজীবনে উদ্ধব দাস আর ঘর থেকে বেরোতেন না। চব্বিশ পরগনার কান্তনগরের একটা কুঠিবাড়িতে বসে বসে নিজের মনে এই কাব্য লিখতেন। বেগম মেরী বিশ্বাস ক্লাইভ সাহেবকে বলে এই জমিটার ইজারা দিয়েছিলেন তাকে। হিন্দুস্থানে তখন ফিরিঙ্গি রাজত্ব কায়েম হয়ে গিয়েছে। মিরজাফর সাহেব তখন শুধু আর শুকনো মিরজাফরনয়, সুজা-উল-মুলক হিসাম-উ-দ্দৌলা আলি মহবৎ জঙ খ বাহাদুর। মিরনও তখন সাহাবত জঙ। এমনকী মিরজাফরের ভাই কাজেম খাঁ পর্যন্ত হেবাৎ জঙ বাহাদুর।
আর ক্লাইভ?
কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ যতদিন ইন্ডিয়ায় ছিল, ততদিন শুধু লড়াই-ই করেছে। লড়াই করেছে বাইরের সঙ্গে আর ভেতরের সঙ্গে লড়াই করেছে মুর্শিদাবাদের নবাবদের সঙ্গে আর নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে। নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে লড়াইটাই ছিল তার বড় কঠোর। সেখানে কারও সাহায্য সে পায়নি। রাত্রে যখন ঘুম হত না তখন শুধু এক দাগ ওষুধ খাইয়ে দিতে হত তাকে। সেই বিষের ওষুধ একটু বেশি খেলেই হয়তো চিরকালের মতো সব যন্ত্রণার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যেত। কিন্তু দুর্ভোগের। যে-মেয়াদ তাকে সারাজীবন সহ্য করতে হবে, তার আগে নিষ্কৃতি হবে কী করে?
মনে আছে সেদিনকার সেই দুর্যোগের কথা। দুর্যোগই বই কী। দরবার হবে চেহেলসূতুনের ভেতরে। তার আগেই সব বন্দোবস্ত ঠিক করে নিতে হবে। যেনবাব কয়েদি হয়ে আছে সেই নবাবের চেয়ে যারা নবাবকে কয়েদ করেছে, তারা আরও শয়তান।
রবার্ট ক্লাইভ বলেছিল–এই মিরজাফর, এই মিরন, এদেরও বিশ্বাস নেই–
মেজর কিলপ্যাট্রিক বলেছিল–ওরা বলছিল নাকি ওদের সোলজারদের মাইনে দেওয়া হয়নি। টাকার অভাবে।
তার মানে, যে-টাকা আমাদের দেবে বলে কনট্র্যাক্ট হয়েছে, তা দেবে না?
হয়তো ওই বলে এড়াতে চাইছে নিজেদের কথা।
ক্লাইভ বললে–তা হলে তার আগেই চেহেল্-সুতুনের মালখানায় ঢুকতে হবে, আর দেরি করা চলে না
মিরজাফর আলি সাহেব তখন এমনিতেই খুশি, শুধু খুশি নয়, মহাখুশি। সুজা-উল-মুলক হিসাম-উ-দ্দৌলা আলি মহবৎ জঙ খাঁ বাহাদুর। বললে–আমিও সঙ্গে যাব কর্নেল
ক্লাইভ বললে–না
কিন্তু কোথায় মালখানা তা আপনি চিনবেন কী করে কর্নেল? আমি চিনি কোথায় আছে মালখানা।
ক্লাইভ তবু অচল-অটল। বললে–না, আমি নিজেই চিনে নিতে পারব
মিরজাফর বললে–কিন্তু যদি একবার ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েন?
ভুলভুলাইয়া? হোয়াট ইজ ভুলভুলাইয়া, মুনশি?
মুনশি নবকৃষ্ণ বললে–হুজুর, গোলকধাঁধা।
তাতেও বুঝতে পারলে না ক্লাইভ সাহেব। গোলকধাঁধা মানে কী?
মুনশি বুঝিয়ে দিলে। নবাব সুজাউদ্দিন এই ভুলভুলাইয়া তৈরি করিয়েছিল বেগমদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলবে বলে। ওখানে একবার ঢুকলে আর বেরোনো মুশকিল। এককালে ওই ভুলভুলাইয়াতে নবাবরা লুকোচুরি খেলত।
তা হলে আপনার সর্দার-খোজাকে সঙ্গে দিন, সে আমাদের রাস্তা দেখাবে!
তা তাই-ই ঠিক হল। আর সবাই বাইরে রইল। ভেতরে ঢুকল কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ, নবকৃষ্ণ মুনশি, খোজা সর্দার পিরালি খাঁ, ওয়াটস্ আর তার একজন মুনশি। মুনশি রামচাঁদ।
যে চেহেল সুতুনে একদিন হাসি আর কান্না, রূপ আর রুপো, যৌবন আর জঙ্ঘা উলঙ্গ হয়ে লীলারঙ্গ চালিয়েছে, সে চেহেল্-সুতুন তখন স্তব্ধ। সেদিন তার কোটরে কোটরে যেন শতাব্দির পর থেকে আবার মৃত আত্মারা ফিরে এসে উঁকি দিয়ে দেখছে। এ কে এল? এরা কারা? আমরা বাংলা মুলুকের মাজমুনদের রক্ত তিলতিল করে আহরণ করে এখানে জমা করে রেখেছি। এ আমাদের আজম-ই-খাস। এর শরিকানা আমাদের। এর দাখিল আমরা বাইরের কাউকে দেব না। তোমরা কৌন? কেন এখানে। এলে? দূর হটো, দূর হটো!
ক্লাইভ সাহেব চারদিকে চেয়ে দেখলে। দেখতে দেখতে তাজ্জব হয়ে গেল। এত বিলাস, এত প্রপার্টি, এত ঐশ্বর্য!
সেদিন ক্লাইভ সাহেব সেই চেহেল্-সুতুনের ভেতরে ঢুকে যেন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনে হয়েছিল, এ জীবন নয়, এই-ই মৃত্যু। এরই নাম মূর্তিমান মৃত্যু। এই মূর্তিমান মৃত্যুর গহ্বরে দাঁড়িয়েই ক্লাইভ সাহেবের হৃদয়ঙ্গম হয়েছিল যে, এ থাকতে পারে না। মানুষের দেনা-পাওনার হিসেব নেবার দিন যখন এসে গেছে তখন এই চেহেল্-সুতুনের অস্তিত্ব থাকা অন্যায়। বহুদিন আগে চকবাজারের খুশবু তেলের দোকানের মালিক সারাফত আলি যা বলেছিল, সেদিন ক্লাইভ সাহেবও সেই কথাই বললে।