সে শুধু বলে চলেছে তুমি তাকে সুখী করো ঈশ্বর। সে যেন মুর্শিদাবাদের পাপ আর পঙ্কিলতা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে গিয়ে যেন সে শান্তি পায়। যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়।
আর-একটা বজরা তখন পেছন থেকে আরও জোরে ছুটে চলেছে। আরও জোরে, আরও বেগে সে ছুটছে। মিরন বজরার পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে দূরে দেখবার চেষ্টা করে। আরও জোরে চালাও, আরও জোরে। দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, মুর্শিদাবাদের মসনদ হাতছাড়া হয়ে যাবে
আর ওদিকে চেহেল্-সুতুনের ভেতরে তখন দরবার বসেছে। ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে গেছে মিরন সাহেব।
উমিচাঁদ জগৎশেঠজির পাশেই এসে বসেছে। শুধু উমিচাঁদ নয়, সবাই এসেছে। এসেছে মনসুর আলি মেহের মোহরার, এসেছে মেহেদি নেসার, এসেছে মিরদাউদ, মিরকাশিম, ইয়ার লুৎফ খাঁ, দুর্লভরাম, রেজা আলি, নন্দকুমার। ফিরিঙ্গিদের দলে এসেছে ওয়াটসন, ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক, ওয়াটস্, মুনশি নবকৃষ্ণ। কে আসেনি?
বিকেলবেলা যখন উমিচাঁদ টাকার জন্যে ছটফট করেছিল, তখন জগৎশেঠজি সান্ত্বনা দিয়েছিলেন–আপনি অত ভাবছেন কেন, আপনার সঙ্গে যখন চুক্তি হয়েছে, তখন তা ফিরিঙ্গিরা মানবেই
উমিচাঁদের তবু ভয় যায়নি। বলেছিল আমার আর কাউকেই বিশ্বাস নেই জগৎশেঠজি—
জগৎশেঠজি বলেছিলেন কিন্তু আপনিই কি নবাবের বিশ্বাস রেখেছেন উমিচাঁদসাহেব?
একথার কোনও উত্তর দেয়নি উমিচাঁদ।
জগৎশেঠজি জিজ্ঞেস করেছিলেন–ক্লাইভসাহেব কোথায়?
চেহেল্-সুতুনের মালখানায় গেছে—
তা আপনি সঙ্গে গেলেন না কেন?
আমাকে সঙ্গে নিলে না। সঙ্গে গেল মুনশি নবকৃষ্ণ।
তারপর?
তারপর আর কী! তারপর থেকে তো আমার সঙ্গে দেখাই করছে না সাহেব। আর তারপর তো আপনার সঙ্গে এখানে এলুম। এখানে এসেও তো সাহেব ব্যস্ত
মনসুর আলি কাগজে লেখা নামগুলো একে একে পড়ছে; আর মিরজাফর সাহেব এক-একজনকে নজরানা দিচ্ছে।
গুলসন বেগম!
বশির মিঞা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল একপাশে। মনসুর আলি মেহেরও দাঁড়িয়ে ছিল। মিরজাফর আলি মসনদের ওপর বসে আছে। নিজামত সরকারের আমলা-ওমরাও সবাই হাজির। সারা মুর্শিদাবাদের লোক আজ শহর-গ্রাম-জনপদ ঝেটিয়ে এসে চেহেল্-সুতুনের আম-দরবারে হাজির হয়েছে। সবাই ভেতরে ঢুকতে পায়নি, সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সকাল থেকেই করোরিয়ান, চৌধুরিয়ান, জমিদারানরা হাজির ছিল। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রও সামনে বসে ছিলেন।
গুলশন বেগমের নাম উঠতেই পেছনের খিড়কি দরজা খুলে এসে হাজির হল একজন। সঙ্গে বাঁদি।
মিরজাফর খাঁ বললেন–এসব আপনার হুজুর, আপনি নিন
সমস্ত বন্দোবস্ত আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। হারেমের খোজা সর্দার পিরালিকে আগে থেকেই হুকুম দেওয়া ছিল। মতিঝিল থেকে আনিয়ে নিয়ে এসে গুনে গুনে রেখে দিয়েছিল চেহেল্-সুতুনে। সমস্ত বেগমরা সকাল থেকে সাজতে গুজতে শুরু করেছিল। চোখে সুর্মা দিয়েছিল। বুকে বুটিদার কাঁচুলি পরেছিল। নখে মেহেদি রং লাগিয়েছিল। ঘাগরা, চোলি, ওড়নি, কিছুই বাদ যায়নি।
পেশমন বেগম!
আজ আর কারও কোনও অভিযোগ নেই। অবশ্য অভিযোগ ছিলও না কোনওদিন। নবাব-হারেমে অভিযোগ থাকতে নেই কারও। তারপর আর একজন। নহবত-মঞ্জিলে এতক্ষণ মিঞা-কি-মল্লার বাজাচ্ছিল ইনসাফ মিঞা।
ছোটে শাগরেদ প্রাণপণে তবলায় চাটি দিয়ে চলেছে।
তক্কি বেগম!
সত্যিই ভাঁটার পর জোয়ার এসেছে। আবার ভাটা আসবে। তারপর আবার জোয়ার। শতাব্দীর পর শতাব্দী এমনি করেই কেটে যাবে। জন্ম থেকে যে-জীবন শুরু হয়, মৃত্যুতেই তার পূর্ণচ্ছেদ পড়বে। কিন্তু মানুষের পৃথিবীর বুঝি মৃত্যু নেই। তাই আবার জন্ম হয়, আবার মৃত্যু আসে। জন্ম-জন্মান্তরের জীবন। তাই অশেষ। শেষের দিকেই তার গতি, কিন্তু সে অশেষযাত্রা। সেই অশেষযাত্রার যে পথিক তার মনে শঙ্কা নেই, তার মনে বিকার নেই, তার মনে অনুতাপ নেই। সে শুধু বলে চলেছে তুমি তাকে সুখী করো ঈশ্বর। সে যেন মুর্শিদাবাদের পাপ আর পঙ্কিলতা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। সে যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়।
মরিয়ম বেগম।
হঠাৎ সব ওলোটপালোট হয়ে গেল। মনসুর আলি মেহের সাহেব নাম ধরে ডাকলে। মিরজাফর আলি সাহেব চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল। কেউ এল না।
এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এগারোজন বেগম এসে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে। মিরজাফর সাহেব অস্থির হয়ে পেছন দিকে চাইতে লাগল। মিরন কোথায়? মিরন?
মিরদাউদ সাহেব চাইলে একবার মিরকাশিম সাহেবের দিকে। মেহেদি নেসার সাহেব চাইলে রেজা আলির দিকে। কিন্তু সবাই বোবা।
মরিয়ম বেগম?..
নহবত-মঞ্জিলে ছোটে শাগরেদ হঠাৎ বলে উঠল–চাচা!
ইনসাফ মিঞা তখন মিঞা-কি-মল্লারে নিখাদে গিয়ে সবে ঠেকেছে। সুরটা থামিয়ে চাইলে ছোটে শাগরেদের দিকে।
ছোটে শাগরেদ বললে–চাচা, মরিয়ম বেগমসাহেবার পাত্তা মিলছে না—
মিরজাফর আলির মাথায় যেন তখন বজ্রাঘাত হয়েছে। খোজা সর্দার পিরালির দিকে একবার চাইলে। বরকত আলি, নজর মহম্মদ তারাও কিছু হদিশ দিতে পারলে না।
ক্লাইভ সাহেব চুপ করে বসে ছিল। মিরজাফর আলি কথা দিয়েছিল, আম-দরবারে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে হাজির করা হবে। কিন্তু কোথায় কী।নবাব মির্জা মহম্মদের বারোজন বেগমের মধ্যে এগারোজনকে পাওয়া গেল। আর একজনকে পাওয়া গেল না। কোথায় গেল সে?