হঠাৎ দরজাটা ফাঁক হয়ে গেল।
সেই লোকটা সসম্ভ্রমে মুখ বাড়িয়ে বললে–এখানে আপনাকে নামতে হবে রানিবিবি, আমরা কাটোয়ায় পৌঁছে গেছি—
*
সেকালের কাটোয়া কেমন জায়গা, পুঁথির মধ্যে তার বেশ বর্ণনা আছে। চারিদিকে মাঠ। মাঠের মধ্যে একটা জায়গায় এসে কয়েকটা বটগাছ চারিদিকটা বেশ ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে। দু-একটা আটচালা। একটা শিবমন্দিরও ছিল। ভাঙাচোরা অবস্থা তার। ঠিক তার পাশেই একটা বাড়ি। পোড়া ইটের পাকা বাড়ি। আর পাশেই গঙ্গা।
এককালে এখানে বর্গিরা এসে হাঙ্গামা বাধিয়েছিল! লুঠপাট করে সব শ্মশান করে দিয়ে গিয়েছিল। সে কয়েক বছর আগেকার কথা। এখন কাছাকাছি গ্রামের চিহ্ন নেই। গ্রামের লোক সেই সময়ে এ-গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল আর আসেনি। কয়েকটা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল বর্গিরা। খেতের ফসল কেটে নিয়ে গিয়েছিল। গোরুছাগল কিছু নিতে বাকি রাখেনি। সেসব এক দিন গিয়েছে। কান্তর মনে আছে সে-সব দিনের কথা।
সে ছিল বড়চাতরা।
খুব ছোট তখন সে। ভাল করে মনে পড়ে না সব কথা। এক-একদিন রাত্রে হইহই করে গা-ময় চিৎকার উঠত। বর্গি এল’ বর্গি এল’ বলে রব উঠত। দিদিমা ঘুম ভাঙিয়ে দিত। বলত–কান্ত ওঠ–
বর্ষার রাত। নাজিরদের ডোবাটার পাশ থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক আসছে অনবরত। গোলপাতার চালের বাতায় দিদিমা বড় বড় কাঁঠাল ঝুলিয়ে রাখত। যে কাঁঠাল পাকেনি, সেই কাঁঠাল বাতি হলেই গোপালকে দিয়ে দিদিমা গাছ থেকে পাড়িয়ে রাখত। তারপর চালের বাতায় দড়ির শিকেয় ঝুলিয়ে রাখত। সেই কাঁঠাল থেকে দু-তিন দিন বাদেই গন্ধ বেরোত। পেকে ভুরভুর করত গন্ধ। গন্ধ পেয়ে হলদে হলদে বোলতা এসে জুটত কোত্থেকে।
তখন কান্ত ছোট। অতদূরে হাত পৌঁছুত না। একটা কচার লাঠি দিয়ে কাঁঠালটার গায়ে লাগাতেই তার মধ্যে লাঠিটা ঢুকে যেত, তখন কাঁঠালটা পেকে একেবারে ভুসভুসে হয়ে গেছে।
দিদিমা দেখতে পেয়ে বলত–কে রে? কাঁঠালটা কে খোঁচালে রে? তুই বুঝি?
শুধু কি কাঁঠাল? আমগাছও ছিল কান্তদের। অত আম কে খাবে তখন! খাবার মধ্যে তো কেবল দিদিমা আর সে! তক্তপোশের তলায় পাকা আমগুলো আমপাতার ওপর সাজিয়ে সাজিয়ে রাখত দিদিমা। রোজ রোজ বেছে বেছে পাকা আমগুলো দিয়ে জলখাবার হত নাতির। সেই পেট-ভরা আম খেয়ে দোয়াত কালিকলম তালপাতা নিয়ে পাঠশালায় যেত কান্ত। স্বরে অ আর স্বরে আ দিয়ে বাংলা হাতের লেখা মকশো করতে হত। কাঁধে আঁকড়ি ক, মুখে বাড়ি খ,…
কিন্তু সেবার সত্যি সত্যিই রাতদুপুরে বর্গিরা এল। নাজিরদের বাড়ির দিকে সকলে দৌড়োচ্ছিল। দিদিমা বুড়ো মানুষ, বেশি জোরে হাঁটতে পারে না। চৌধুরীবাবুদের বুড়ো কর্তা বাতের ব্যথায় পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন বিছানায়। তিনি আর দৌড়োত পারলেন না, ধপাস করে মাটিতে পড়ে মরে গেলেন। চৌধুরীবাড়ির নবউ পেছনে ছিল, শ্বশুরকে পড়ে যেতে দেখে ন’বউ থেমে গেল। শাশুড়ি তখন এক নাতির হাত ধরে আর এক নাতিকে কোলে নিয়ে দৌড়াচ্ছে।
কর্তাকে পড়ে যেতে দেখে শাশুড়ি গিন্নি বললে–উনি থাকুন নবউমা, তুমি চলো, পোয়াতি মানুষ তুমি, তুমি আগে নিজের পেরান সামলাও—
বুড়োকর্তা সেখানেই পড়ে রইলেন। চৌধুরীবাড়ির বড়কর্তা, মেজকা, সেজকর্তা, নকর্তা তখন বাড়ির বড় বড় লোহার সিন্দুকগুলো ধরে ধরে সেই ডোবা পুকুরের মধ্যে ডুবোচ্ছে। চৌধুরীবাবুদের অবস্থা ভাল। রুপোর থালাবাসন ছিল, সোনার বাট ছিল, সমস্ত সেই রাত্তিরে পুকুরের পাকের মধ্যে পুঁতে ফেললে। তারপর লাঠি-সড়কি নিয়ে মাথার ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে চার ভাই বেরিয়ে পড়ল।
আর শুধু কি চৌধুরীরা?
বড়চাতরার যত লোক ছিল সব পালিয়ে বাঁচত বাড়িঘর ছেড়ে। চাল-ডাল-নুন তেল ফেলে রেখে শুধু প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে গ্রাম-কে-গ্রাম উজাড় হয়ে যেত! কোথায় যেত তার ঠিক নেই। নাজিরদের বাড়িটায় একতলায় মাটির নীচেও ঘর ছিল। নাজিররা সেখানেই লুকিয়ে থাকত।
দিদিমা বলত–তুই যেবার হলি সেবারও বর্গি এইছিল, তোকে কোলে নিয়ে তোর মা আর আমি নাজিরদের বাড়ির তলায় গিয়ে লুকোলুম–
খুব ছোটবেলায় দিদিমার কাছে এইসব গল্প শুনত। শুধু দিদিমা কেন, সে-গল্প বড় চাতরার সবাই জানত। ওই পাঠশালার পশ্চিম দিকের কালাচাঁদের মঠ পেরিয়ে যেখানে বিরাট একটা ঝাকড়া-মাথা বটগাছ হা হা করে আকাশের দিকে হাত তুলে বোশেখ-জষ্ঠি মাসের বিকেলবেলার দিকে তুমুল কাণ্ড করে বসে, তারও ওপাশে রাজবিবির মসজিদ, সেই রাজবিবির মসজিদ ছাড়ালেই সরকারি সড়ক। সেই সড়ক দিয়ে সোজা হেঁটে গেলেই তিন দিনের মধ্যে রাজমহল পৌঁছিয়ে যাবে। নাজিরবাবুদের সর্দার পাইক দফাদার ওই সরকারি সড়ক দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আসত। চৌধুরীবাবুরা যখন একবার কাশীধামে গিয়েছিল, তখন ওই পথ ধরেই গিয়েছিল। গিয়ে পাটনার গঙ্গা থেকে নৌকো নিয়েছিল। আর ঠিক ওই রাস্তা বরাবরই বর্গিরা আসত। একেবারে পঙ্গপালের মতো হুড়মুড় করে এসে ঢুকে পড়ত বড়চাতরায়। ঠিক যখন খেতের ধান কাটবার সময় হত, সেই সময়ে কোত্থেকে এসে হাজির হত আর তারা চলে যাবার পর খাঁ খাঁ করত সমস্ত বড়চাতরা।
বড়চাতরার লোকে কান্নাকাটি করত গা দেখে। কতবার ঘর-বাড়ি-গোলা মরাই-খেত-খামার সমস্ত জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে গেছে বর্গিরা।