ভদ্রলোক বললেন–সে তো আছেই, কিন্তু বেগম মেরী বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? বেগম তো মশাই মুসলমান–
আমি বললাম–শুধু মুসলমান কেন, মুসলমান তো বটেই, আবার ক্রিশ্চানও বটে, তার ওপর মনে হচ্ছে হিন্দুও–
তারপর বললাম–আমি এক মাসের জন্যে এটা নিয়ে গিয়েছিলাম, তাই ফেরত নিয়ে এলাম, আপনি যদি একটু সময় দেন তো আরও কিছুদিন রেখে পড়ে দেখতে পারি।
ভদ্রলোকের তাতেও আপত্তি দেখলাম না। বলতে গেলে ভদ্রলোকের কাছে এ-পুঁথির কোনওই দাম নেই। পুরনো বাড়ি মেরামত করতে গিয়ে মাটির তলায় আরও অনেক কিছু জঞ্জালের মধ্যে এটা পাওয়া গিয়েছিল। দুশো বছরের পত্তনি এঁদের। তখন এ অঞ্চল জঙ্গলে ভরতি ছিল। চোর-ডাকাতদের ভয়ে তখনকার মানুষ অনেক জিনিসই মাটির তলায় পুঁতে রাখত। খাস বিশ্বাস পদবি যাঁরা পেয়েছিলেন তাঁরা জায়গিরের সঙ্গে কিছু ধনসম্পত্তিও পেয়েছিলেন। সেই ধনসম্পত্তি নিয়েই তারা এসেছিলেন এখানে। ধনসম্পত্তি সে-যুগে লুকিয়ে রাখার জিনিস। কেউ কখনও জানতে পারলে তার আর নিস্তার নেই। উদ্ধব দাস এখানে সেই ধনসম্পত্তি নিয়েই হয়তো একদিন গড়ম্বন্দি তৈরি করলেন। চকমিলানো বাড়ি তৈরি করলেন। ভাবলেন খাস বিশ্বাস বংশ যুগ থেকে যুগান্তর ধরে তার কীর্তিগাথা প্রচার করবে। কিন্তু আস্তে আস্তে বিবাদ শুরু হল শরিকদের মধ্যে, ভাগীরথীর জল শুকিয়ে আসতে লাগল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা দেশের রাজা হয়ে বসল, কুইন ভিক্টোরিয়া থেকে শুরু করে একাদিক্রমে এক-একজন রাজা এসেছে আর খাস বিশ্বাসদের অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে গেছে।
বাড়িতে এসে পুথিখানা পড়তে পড়তে আমার চোখের সামনে থেকে যেন ধীরে ধীরে মহাকালের পরদাগুলো আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল। পয়ার ছন্দে লেখা কাব্য। পয়ারের চৌদ্দটি অক্ষর যেন চৌদ্দ হাজার প্রদীপের আলোর প্রার্য নিয়ে আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এই কলকাতা শহর, এই বিংশ শতাব্দী, এই বাড়ি ঘর রাস্তা, এই সভ্যতা, শিক্ষা, ভণ্ডামি, প্রতিযোগিতা আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জয়ের যুগে আমি সশরীরে যেন আর এক যুগে গিয়ে পৌঁছোলাম। তখন পিচের রাস্তা হয়নি কোথাও। ইলেকট্রিক লাইটও হয়নি। মটর, ট্রেন, প্লেন কিছুই হয়নি। শুধু একটা পালকি চলেছে কালনার মেঠো পথ দিয়ে।
দু’পাশে মাঠ। মধ্যে গোরুর গাড়ি যাবার মতো খানিকটা রাস্তা।
ওপাশ থেকে বুঝি ধুলো উড়িয়ে কারা আসছিল। ঘোড়ার খুরে রাস্তার ধুলো উঠে আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। কাছে আসতেই দেখা গেল নবাবের সেপাই তারা। সেপাইরা পালকি থামিয়ে দিলে।
কে? ভেতরে কে আছে?
আজ্ঞে জেনানা!
কাদের জেনানা?
ষণ্ডা-গুন্ডা সেপাই দুটো সোজা কথায় ছাড়বার লোক নয়। মেয়েমানুষের নাম শুনলে জিভ দিয়ে নাল পড়ে ওদের। রোদ টা টা করছে চারদিকে। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাবার জোগাড়। চারজন চারজন আটজন পালকি-বেহারা। পালা করে বয়ে নিয়ে চলেছে। ফেরিঘাটের কাছে একবার একটু জলটল খেয়ে নিয়েছিল বেহারারা। ফেরিঘাটের নৌকোর মাঝিও একবার কান্তকে একা পেয়ে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করেছিল–পালকিতে ইনি কে কত্তা?
এমনিতে সন্দেহ হবারই কথা। অন্তত একটু কৌতূহল। মানে সঙ্গে তো আর কোনও স্ত্রীলোক নেই। একলা-একলা এই পথেঘাটে এমন রূপসি মেয়েমানুষ দেখলে মানুষের জানতে ইচ্ছে হয় বই কী! দিনমানই হোক আর রাতবিরেতই হোক, মেয়েমানুষ যায় নাকি এমন করে!
কান্ত জবাব দিয়েছিল–আমাদের হাতিয়াগড়ের রানিবিবি!
কথাটা শুনে বুড়ো মাঝির কোথায় কৌতূহল নিবৃত্তি হবে, তা নয়; চোখ দুটো যেন আরও বড় বড় হয়ে গেল। হাতিয়াগড়ের জমিদারগিন্নির তো পালকিতে যাবার কথা নয়। গেলে নৌকোতে যাবেন। জমিদারের নিজেরই তো বজরানৌকো আছে। এই ফেরিঘাটেই কতবার বাবুর বজরা বাঁধা হয়েছে।
আপনারা?
কান্ত বললে–আমরা নবাব সরকারের লোক—
কথাটা শুনেই বুড়ো মাঝি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। লম্বা একটা সেলাম করেছিল সসম্ভ্রমে। সম্ভ্রমে বটে ভয়েও বটে। মুর্শিদাবাদের নিজামত নবাব সরকারের কথা শুনলে কার না ভয় হয়। ভয়েই বোধহয় আর কোনও কথা বলেনি বুড়ো মাঝিটা। ঘন ঘন সেলাম করেছিল। দুটো সেপাই সঙ্গে ছিল। আর ছিল আটজন পালকি-বেহারা। আর কান্ত নিজে। এইসব এত লোকের বহর দেখেই মাঝিটার সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু কথাটা শোনবার পর আর বাক্যব্যয় করেনি। পালকিসুদ্ধ নদীপার করে দিয়ে আর একটা লম্বা সেলাম করেছিল কান্তকে।
তারপর আর কিছু ঘটেনি। এতদূর আসার পর আবার সেই সেপাই।
কাদের জেনানা?
পালকির ভেতরে যে গুটিসুটি মেরে চুপ করে বসে ছিল, কথাটা বুঝি তার কানেও গেল। মাথার ঘোমটাটা সে একটু নামিয়ে দিলে। একলা-একলা চুপ করে বসে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণ বাইরে থেকে কেবল পালকি-বেহারাদের হুস-হাস শব্দ ছাড়া আর কিছু ছিল না।
শোনা গেল সঙ্গের লোকটা বলছে–আমাদের হাতিয়াগড়ের রানিবিবি।
কোথায় যাবে?
মুর্শিদাবাদ, চেহেল্-সুতুন।
পাঞ্জা?
বাইরের আর কোনও কথা শোনা গেল না ভেতর থেকে।
হাতিয়াগড়ের জমিদারগিন্নি উদগ্রীব হয়ে কান পেতে রইল। কেউ আর কিছু বললে–না। সেপাই দুটো বোধহয় পাঞ্জা দেখে খুশি। কেউ আর পালকির দরজা খুলে পরীক্ষা করতেও চাইলে না। তারপর কেবল বেহারাদের হুস-হাস শব্দ। সারা শরীরটা দুলছে সেই সকাল থেকে। নদীতে যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ বেশি কষ্ট হয়নি। নৌকোর ঘরের মধ্যে একা-একা কেটেছে। ওরা বাইরেই ছিল। বাইরেই ওরা খেয়েছে, বাইরেই ঘুমিয়েছে। আর সেপাই দুটো পাহারা দিয়েছে কেবল বসে বসে।