কবে এই বংশের কোন আদি পুরুষ এখানে একদিন আস্তানা গেড়েছিলেন। সে হয়তো পলাশীর যুদ্ধের পর কোনও একটা সময়ে। তখন লর্ড ক্লাইভের আমল। লাইব্রেরির পুরনো পুঁথি ঘেঁটে দেখছি, বাদশা দ্বিতীয় আলমগিরের রাজত্বের চতুর্থ বছরে হিজরি ১১৭০ ৫ রবি-উল-শানি, ইংরেজি ১৭৫৭ খ্রি অব্দের ২০ ডিসেম্বর, বাংলা ১১৬৪ সালের পৌষ মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব মিরজাফর খাঁ’র কাছ ণেকে জমিদারস্বরূপ ভেট পান এই ২৪ পরগনা। পরগনা মাগুরা, পরগনা খাসপুর, পরগনা ইক্তিয়ারপুর, পরগনা বারিদহাটি, পরগনা আজিমাবাদ, পরগনা মুড়াগাছা, কিসমত সাহাপুর, পরগনা সাহানগর, কিসমতগড়, পরগনা দক্ষিণ সাগর, আর তারপর পরগনা কলিকাতা। সরকার সাতগাঁ’র অধীনেই কিসমত পরগনা কলকাতা। ইত্যাদি ইত্যাদি—
এই কিসমত পরগনা খুঁজে বার করা মুশকিল। এখনকার ম্যাপে এর নিশানা নেই।
বাদশাহ্ আলমগিরের রাজত্বের চতুর্থ বছরে ১৫ রমজান তারিখে ইংরেজ কোম্পানি আর মিরজাফরের মধ্যে যে সন্ধিপত্র লেখা হল সেখানে অষ্টম আর নবম ধারায় লেখা আছে–
Article VIII–Within the ditch, which surrounds the borders of Calcutta, are tracts of land, beloging to several zemindars; besides this I will grant the English Company six hun dred yards without the ditch.
Article IX–All the land lying to the south of Calcutta, as far as Culpee, shall be under the zemindary of the English Company, and officers of those parts, shall be under their jurisdiction.
The revenue to be paid by them (the Company) in the same manner with other zeminders.
এ হল পরোয়ানা।
এতে খুশি হবার লোক নন ক্লাইভ সাহেব। কোম্পানির সুনাম প্রতিপত্তি হলে তার কী লাভ? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লাভের সঙ্গে তার তো কোনও সম্পর্ক নেই। কথাটা জাফর আলি খাঁ বুঝলেন। তাই যখন দিল্লির বাদশার সনদ এল তখন দেখা গেল তাতে আর কোম্পানির নাম নেই। তাতে ক্লাইভেরই জয়জয়কার। তখন তাতে আর শুধু শুকনো কর্নেল ক্লাইভ নয়। ক্লাইভের তখন একটা লম্বা-চওড়া পদবি। জবদন্ত-উল-মুলক নাসেরাদ্দৌলা সবত-জঙ্গ বাহাদুর কর্নেল ক্লাইভ। তিনিই তখন দিল্লির বাদশার সনদ পেয়ে ২৪ পরগনার জায়গিরদার জবদস্ত-উল-মুল নাসেরাদ্দৌলা সবত-জঙ্গবাহাদুর কর্নেল ক্লাইভ হয়ে গেছে।
ভদ্রলোক বললেন–ওসব হিস্ট্রির কচকচি আমরা শুনতে চাই না মশাই, আমরা চাল-ডাল-মাছ তরকারির ব্যবস্থা করতে করতেই নাজেহাল, জিনিসপত্তরের যা দাম বাড়ছে তাইতেই আমরা মরে আছি, ওসব পড়বার ভাববার শোনবার সময় কোথায় পাই বলুন?
তারপর বললেন–পুঁথিটার মধ্যে কী পেলেন আপনি?
বললাম–একটা অমূল্য জিনিস পেলাম এর মধ্যে। যা এখন পর্যন্ত কোনও ইতিহাসে পাইনি।
কী রকম?
বললাম পেলাম বেগম মেরী বিশ্বাসের নাম—
তিনি কে?
বললাম–এতদিন এই দুশো বছর ধরে আপনাদের বাড়িতে এ-পুঁথিটা রয়েছে আর একবার এটা পড়েও দেখেননি? দেখলেই জানতে পারতেন বেগম মেরী বিশ্বাস কে?
সত্যিই ভদ্রলোক আসল সংসারী মানুষ। নাম পশুপতি বিশ্বাস। সারাজীবন মামলা করেছেন, অর্থ উপায় করেছেন, যৌবনে ফুর্তি করেছেন, সন্তানের জন্ম দিয়েছেন আর ভাল ভাল খেয়েছেন আর পরেছেন। শরিকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবুয়ানি করেছেন। পাড়ার দশজনের মাথার ওপর মাতব্বরি করেছেন। সাধারণত বাংলাদেশের সেকালের আরও নিরানব্বইজন লোক যা করে থাকেন, পশুপতিবাবুও তাই-ই করেছেন। কোথা থেকে এই বাংলাদেশ এল, এ-দেশ আগে কী ছিল, কী করে এই অজ জলাজমি এখনকার বাংলাদেশে পরিণত হল সেসব জানবার আগ্রহ তার কখনও হয়নি। জেনে কোনও লাভ হবে না বলেই আগ্রহ হয়নি। বেশ আছি মশাই, খাচ্ছিদাচ্ছি, বাত-হাঁপানি-ব্লাডপ্রেশার-ডায়াবেটিস নিয়ে অত সব খবর রাখবার সময় কোথায় আমাদের? জানেন, তিন-তিনটে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি তিন কুড়িং ষাট হাজার টাকা খরচ করে? ক’জন পারে বলুন আজকালকার বাজারে? প্রথম জামাই মেডিকেল ডাক্তার, সাতশো টাকা মাইনে পায় ডি-ভি-সি’তে, সেকেন্ড জামাই ইঞ্জিনিয়ার….
বাংলাদেশের ইতিহাস জানার চেয়ে নিজের কীর্তিকাহিনী পরকে জানাবার দিকেই পশুপতিবাবুর আগ্রহটা যেন বেশি। সেকালের পুরনো জমিদার বংশ। মাত্র দুশো বছর আগে পর্যন্তই পশুপতিবাবুদের বংশাবলীর কিছু পরিচয় জানা যায়। কোন এক উদ্ধব দাস নাকি এইখানে এই কিসমত পরগনা কলিকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। এখানে এই গঙ্গার ধারে কান্তসাগরে চোদ্দো বিঘে জমির পত্তনি পেয়ে একটা ছোটখাটো বাড়ি করেন। পশুপতিবাবুরা উচ্চরাঢ়ী কায়স্থ। দিল্লির বাদশার কাছ থেকে উদ্ধব দাস ‘খাস বিশ্বাস’ উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু নিজেদের নামের শেষে শুধু দাস পদবি লেখেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলেই ওই বিশ্বাস পদবিটা চালু হয়ে গেছে। কিন্তু বিয়ে-শ্রাদ্ধ-অন্নপ্রাশনে খাস বিশ্বাস কথাটা এখনও ব্যবহার করতে হয়। ওটা চলে আসছে এবংশে।
ভদ্রলোক তখন অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন–বেগম মেরী বিশ্বাস আমাদের কেউ হয় নাকি? কী দেখলেন ওতে?
বললাম–সেইটেই তো খুঁজছি–পাতা তো সব নেই, অর্ধেক ছেঁড়া, পোকায় খাওয়া আমার মনে হচ্ছে আপনাদের বাড়িতে যখন এ-পুঁথি পাওয়া গিয়েছে তখন এই পুঁথির লেখকের সঙ্গে আপনাদের নিশ্চয় কিছু যোগাযোগ আছে–