সে করুণাদেবীকে বলেছিল সেদিন–এরা মিলবে কি করে দেবী? কি করে জানবে এরা?
দেবী হেসে উত্তর দিয়েছিলেন ওদের সাধ্য কি? আমরা সে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবো সময় এলে। দেখতেই পাবি, পুষ্প।
অভয়ের মা ছেলেকে খাইয়ে দাইয়ে পাশের ঘরে ঘুমুতে পাঠায়। পুষ্প এসে সেই সময় খোকার শিয়রে এসে বল্লেখোকা ঘুমুল পাড়া জুড়ল, ঘুমোও যতুদা, ঘুমোও–দুষ্টুমি করলে মায়ের হাতের চড় মনে। আছে তো?
অভয় ঘুমিয়ে পড়লে হয়তো এক একদিন কোনো রূপসী দেবীর স্বপ্ন দেখে, মায়ের মত স্নেহে তার শিয়রে বসে ঘুম পাড়াচ্চে। মায়ের মতই বলে মনে হয় তাকে।
নৈশ আকাশ দিয়ে তারপর পুষ্প উড়ে চলে যায় তার নিজ লোকে। অগণ্য জ্যোতিৰ্ম্মণ্ডল অগণ্য ব্রহ্মাণ্ড মহাব্যোম সৰ্ব্বত্র ছড়িয়ে,–অগণ্য জীবকুল, অগণ্য জীবনমৃত্যুর প্রবাহ।
পুষ্পের মন বলে ওঠে–কোথায় আছ হে কারণার্ণবিশারী মহাবিষ্ণু, মহাদেবতা, মুখের আবরণ অপসারণ কর–অপবৃণু, অপবৃণু, আমরা তোমার স্বরূপ দেখি–ধন্য কর আমাদের জন্মমরণ, দয়ালু দেবতা!
স্বর্গ ও মর্তের সেই মোহনায় পুষ্প এসে দাঁড়ালো।
ওর কিছুদূরে নীল শুন্যে আগুনের লেখা এঁকে বিরাট এক ধুমকেতু অগ্নিপুচ্ছ দুলিয়ে নিজের গোঁ ভরে চলে গেল।–সে মুহূর্তের হিসেব নেই। ওদের পায়ের তলায় কোন গ্রহের এক নদীতীর, হয়তো বা পৃথিবীরই–শান্ত অপরাহ্ন, একদল সাদা বক মেঘের কোলে কোলে উচড়ে নলখাগড়া বনের ঊর্ধ্বে আকাশে।
আজ পুষ্প যেন দেখতে পেলে সেই দেবতাকে–নক্ষত্রজ্যোৎস্নায় ভাসানো এই অপূৰ্ব্ব জীবন-উল্লাসের স্রোতে সে জন্ম থেকে জন্মান্তরে ভেসে চলেচে যে মহাদেবতার ইঙ্গিতে। কোথায় যেন তিনি মহাসুপ্তিমগ্ন, তাঁর অপূর্ব সুন্দর মুখোনি, সুন্দর চোখ দুটি। পুষ্প বল্লে–উনি উঠবেন কখন? চরণ বন্দনা করি।
পুষ্পের মনের মধ্যে থেকে প্রশ্নের উত্তর এল–উনি ওঠেন না। অনন্ত শয্যায় অনন্ত নিদ্রায় মগ্ন উনি। এক এক নিশ্বাসে যুগযুগান্ত কেটে যায়। তুমি ওঁর চরণ বন্দনা করবে? ওঁর উপাসনা হয় না। কে করতে পারে ওঁর উপাসনা? উনি কাউকে দেখেন না, কারো উপাসনা গ্রহণ করেন না। বিশ্বজগৎ ওঁর স্বপ্ন–উনি ঘুম ভেঙে জেগে উঠলে জগৎস্বপ্ন লয় হয়ে যাবে যে! সৃষ্টি অন্তর্হিত হবে। কিন্তু তা হয় না–সৃষ্টিও অনন্ত, ওঁর সুপ্তিও অনন্ত। উনিই বিশ্বের আদি কারণ– সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম। ক্ষীরোদশয়নশায়ী মহাদেবতা ব্রহ্মাণ্ডের। তুমি আমি, স্বর্গ নরক, জন্ম মরণ, দেব দেবী, ঈশ্বর, পাপ পুণ্য, দেশ ও কাল– সবই তাঁর স্বপ্ন। সব তিনি। তিনি ছাড়া আর কিছু নেই–কে কার উপাসনা করবে? ওঁর স্বপ্ন ছাড়া আর উনি ছাড়া আর কি আছে?
ভক্তিভরে প্রণাম করলে পুষ্প। উপাসনা হয় না তো হয় না।
ঘন ঘুমে অচেতন সেই দেবদেবের সুন্দর চোখ দুটি, স্বর্গ ও মর্ত্যের দূরতম প্রান্তে, শুকতারার অস্তপথে, ছায়াছবির মত মিলিয়ে গেল।
(সমাপ্ত)