কেউ নেই আজ এখানে।
যতীনদা চলে গিয়েচে আজ দশটি বছর।….
ঊর্ধ্বে যতদূর দৃষ্টি যায়–আজ এতকাল পরে তার কাছে শূন্য অর্থহীন!
এক এক সময়ে মনে হয় সেই ভ্রাম্যমাণ বহূদক দেবতা যদি আসেন! তাঁর মুখে বহু জগতের, বহু নক্ষত্রলোকের, বহু বিশ্বের গল্প শোনে। নিজে তিনি বেড়িয়ে দেখছেন, এখনও দেখছেন–শেষ করতে পারেন নি।
সন্ন্যাসী এসে প্রায়ই বলেন–মহর্লোকে তোমার আসন, এখানে কি নিয়ে পড়ে আছ কন্যে? সেই পৃথিবীর গঙ্গা, পৃথিবীর হালিসহর সাগঞ্জ, নৌকো–এসব মায়িক কল্পনা তোমার সাজে না। ছি ছি
পুষ্প সকৌতুকে বলেছিল–নিয়ে যান না তার চেয়ে উচ্চতর লোকে, যাচ্চি এখনি।
সন্ন্যাসী বলে–জ্ঞান থাকবে না বেশিক্ষণ। কারণ এসব লোক আত্মিক অবস্থা মাত্র। কোনো স্থান নয়। সে উচ্চতর চৈতন্য জাগ্রত হোলে পৃথিবীতে জড়দেহধারী হলেও তুমি সত্যলোকের অধিবাসী। যেমন দেখেছিলে আমার সেই গুরুভ্রাতাকে। চিদানন্দময় আত্মা সেখানে। আপনার অস্তিত্বের আনন্দে বিশ্বের সঙ্গে এক সুরে গাঁথা। মুখে বলা যায় না সে অনুভূতির কথা।
পুষ্প বল্লে–বুঝবার ক্ষমতা নেই আমার দেব। তবে শুনলাম বটে। আপনার দয়া।
–বিধাতৃপুরুষদেরও উচ্চস্তরের দেবতাদের দেখা পাওয়ার জন্যে তপস্যা করতে হয় জানো তো? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাতজন বিধাতৃপুরুষ আছেন, এদের ওপর ঈশ্বর। বিধাতৃপুরুষেরা ইচ্ছা করলেই ভগবানের লোকে যেতে পারেন না–গেলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এজন্যে তপস্যা দ্বারা শক্তি অর্জন করতে হয়–তবে সেই সাময়িক তপস্যার সাময়িক শক্তি নিয়ে ঈশ্বর সমীপে যেতে পারেন। অথচ বিধাতৃপুরুষেরা সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় করছেন।
–ভগবান তবে কি করছেন, তিনি কি ঠুটো জগন্নাথ?
–তাঁর ইচ্ছাতেই সব হচ্চে, কন্যে। একটা তৃণও নড়ে না তাঁর ইচ্ছা না হোলে।
–তিনি দয়ালু? ডাকলে সাড়া দেন?
–এখনও এ সন্দেহ? এইজন্যে আমি বলি, প্রর্থনা করো না তাঁর কাছে কিছু। প্রার্থনা করলেই তিনি মঞ্জুর করেন। তিনি পরম করুণাময়। জীবের দুঃখ দেখে থাকতে পারেন না। হয়তো এমন অসঙ্গত প্রার্থনা করে বসলে, যা মঞ্জুর হোলে তোমার আত্মার অমঙ্গল। এইজন্যে কিছু চাইতে নেই তাঁর কাছে–তিনি আমাদের মঙ্গলের দিকে দৃষ্টি রেখে সব কিছু করে যাচ্চেন বা বিধাতৃপুরুষদের কৰ্ম্মে সম্মতি দিয়ে যাচ্ছেন। এইজন্যে অনেক সময় ভগবানকে নিষ্ঠুর বলে মনে হয়। জীবের কল্যাণের জন্যে তিনি ব্যবস্থা করছেন, আমাদের তা মনঃপুত হচ্চে না।
–ক্ষেমদাস তাই বলেন।
–কে? আমাদের কবি? ওর কথা বাদ দাও। আজ এত বছরেও ওর ভাবালুতা ওকে ছেলেবেলার ওপরে উঠতে দিলে না! গোপাল। আর বৃন্দাবন, আর আরতি, আর চোখের জল–আর চাঁদের আলো।
সন্ন্যাসী সেদিন বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। পুষ্পের হাসি পায় ওঁর সব কথা ভেবে। মেয়েমানুষের মনের কথা এরা কি করে জানবে? শুদ্ধ, বুদ্ধ আত্মা ওরা–ব্রহ্মের মত হয়ে গিয়েছে। শত স্নেহ প্রেম প্রীতির। বাঁধনে যে মেয়েমানুষের মন বাঁধা। এও সেই বিধাতৃপুরুষদেরই গড়া নিয়ম তো, সৃষ্টিছাড়া কিছু নয়।
পৃথিবীতে কি সন্ধ্যা হয়ে এসেছে?
পুষ্প একবার নীচের দিকে চেয়ে দেখলে, তারপর পৃথিবীর সন্ধ্যায় দেহ মিলিয়ে নেমে এল কোলা-বলরামপুর গ্রামে। যতীনের মা রান্নাঘরের মধ্যে ভাত চড়িয়ে উনুনের পাশে বসে আলুবেগুন কুটচে। সে আর ঠিক তরুণী নয় এখন, বিগত-যৌবনের চিহ্ন সারা দেহে পরিস্ফুট। নতুন ধান এসেছে সামনের উঠানে, শীতের সন্ধ্যা, পাশের বাড়ীর আমতলায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আগুন জ্বেলে পোয়াচ্চে।
যতীনের মা রান্নাঘর থেকে বল্লেও অভয়–কোথায় গেলি?
পাশের বাড়ীর আমতলায় সে সব ছেলেমেয়ে আগুন পোয়াচ্চে, তাদের ভেতর থেকে একটি আট-ন’ বছরের বালক উত্তর দিলে– কেন, কি হয়েছে?
–ঠাণ্ডা লাগাস নি বাইরে। ঘরের মধ্যে আয়।
বালকের এখন সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সমবয়সীদের মজলিস ছেড়ে এসে। রান্নাঘরে ঢুকতে। সে বল্লে–আমি বাইরে বসে ধান চৌকি দিচ্চি যে–
–না, তোমায় ধানচৌকি দিতে হবে না। চলে আয় ঘরে। এই উনুনের পাড়ে বসে আগুন পোয়া। ছেলের লেগেই আছে সর্দি কাসি– আবার রাত পজ্জন্ত বাইরে বসে থাকা–
আর একটি ছেলে ওকে বল্লে–যা, কাকিমা বকবে–
অভয় মুখ ভার করে মায়ের কাছে উনুনের পাশে এসে বসলো। ওর মা বল্লে–সেই গরম জামাটা আজ গায়ে দিস্ নি?
–আহা হা–সে তো ছেঁড়া!
–তা হোক, নিয়ে আয়, বড্ড শীত পড়েছে।
–না মা।
অভয়ের মা ছেলের গালে এক চড় কষিয়ে দিয়ে বল্লে–তোমার একগুঁয়েমিগিরি ঘুচিয়ে দেবো আমি একেবারে। দুষ্টু ছেলে–এখুনি বলবেন, মা আমার জ্বর এয়েছে–তখন নিয়ে এসো সাবু, নিয়ে এসো ওষুধ–যা নিয়ে আয় জামা, মাঝের ঘরের আনলায় আছে–
পুষ্প খিল খিল করে হেসে উঠে বল্লেও যতুদা, কেমন মজা? এ আমি নয় যে একগুয়েমি করে নিস্তার পাবে–
পুষ্প এই সময়টা মাঝে মাঝে এখানে এসে কাটায়। অভয়ের মা। ছেলেকে খাওয়ায়, কাছে বসে পড়ায়–প্রথমভাগ, ধারাপাত–পুষ্প বসে বসে দেখে। বেশ লাগে ওর।
স্বপ্নের মত মনে হয় সংসারের জীবনমৃত্যু…সন্ন্যাসীই জ্ঞানী, সব মায়া আর স্বপ্ন।
আশা বৌদিকেও একদিন সে দেখে এসেচে। সে এখন বহু দূর মুরশিদাবাদ জেলায় এক মাঝারি গোছের গেরস্তবাড়ীর ছোট একবছরের খুকি।