–হাঁ।
–তিনি কি নিষ্ঠুর–ওঃ! এই তো?
পুষ্প হাসি-হাসি মুখে নির্বাক।
ক্ষেমদাস বল্লেন–তোমার মত মেয়েরও বিস্মৃতি? তোমার ভুল? একেই বলে মাহিনী মায়া। মায়ায় কে না ভোলে। ব্রহ্মা বিষ্ণু তলিয়ে যান।
–কেন দেব, বলুন!
-না, তাই দেখচি। নতুবা তোমারও ভুল।
–থাক আমার ব্যাখ্যা। আমি তৃণের চেয়েও হীন। আপনি কি উপদেশ করচেন তাই করুন না?
ক্ষেমদাস হাসিমুখে বল্লেন–ভগবান কার উপর নিষ্ঠুর হবেন? সবই তো তিনি। নিজেই নিজের লীলায় তন্ময় হয়ে আছেন বিভিন্ন রূপে। তিনিই সব। সে জ্ঞান যেদিন হবে সেদিন এই নিকৃষ্ট লোকের নিকৃষ্ট জীব দেখেও বলে উঠবে আনন্দে–তেজো যৎ তে কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি, যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি–
ক্ষেমদাস চলে গেলেন। যাবার সময় বল্লেন–বৃন্দাবন থেকে ঘুরে আসি। তোমার সঙ্গে আবার শীঘ্রই দেখা করবো–একদিন চলো সেই সন্ন্যাসিনীর কাছে যাবো।
পুষ্প স্থির ভাবে বসে রইল শৈলশিখরে। এখানে তার যতুদা আছে, কত জন্মের প্রিয় সাথী সে। তাকে ফেলে কোথায় কোন লোকে গিয়ে সুখ পাবে সে? একটি গোয়ালার মেয়ে দুধ দুয়ে নিয়ে আসছে বাজারে। নরনারী প্রদীপ ভাসাচ্চে গঙ্গাবক্ষে। দূর থেকে আলো দেখা যাচ্চে জলের ওপর।
বুড়োশিবতলার পুরানো ঘাটের সামনে গঙ্গাবক্ষে পালতোলা। নৌকোর দল চলেচে। গোধূলির আবছায়া আকাশে শুভ্রপক্ষ বকের দল উড়ে চলেচে ওপারে হালিসহরের শ্যামাসুন্দরীর ঘাটের দিকে। প্রাচীন দেউলমন্দিরের চূড়া সান্ধ্য দিগন্তের বননীল-রেখায় এখানে ওখানে যেন মিশে আছে।
পুষ্প ঘাটের রানায় বসে ক্ষেমদাসের সঙ্গে কথা বলছিল।
ক্ষেমদাস বৃন্দাবন থেকে এইমাত্র ফিরেছেন। জ্যোৎস্নারাত্রে যমুনাতীরে কিছুক্ষণ বসে ছিলেন চীরঘাটের কাছে। আরতি দর্শন। করবার পরে। মন ভূমানন্দে বিভোর।
পুষ্প বল্লে–কবি, স্ফটিকের কথা কি বলছিলেন?
ক্ষেমদাস গঙ্গার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বল্লেন–ওই দ্যাখো, রাঙা আকাশের ছায়া পড়েছে জলে। জল যদি ঘোলা হোত, আকাশের ছায়া পড়তো না। স্ফটিককে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নিৰ্ম্মল হতে হবে, তবে আলো তার মধ্যে দিয়ে আসবে।
–অর্থাৎ?
–অর্থাৎ আত্মাতে যদি এতটুকু ত্রুটি থাকে কোথাও, তবে ভগবানের আলো তার মনে, নামে না। সম্পূর্ণ নিৰ্ম্মল স্ফটিক হাওয়া চাই এতটুকু খুৎ থাকলে চলবে না।
–ভগবানের দাবি এত বেশি কেন?
–উপায় নেই। ভগবানের আলো যদি মনের দর্পণে ঠিক অখন্ড ভাবে পেতে কেউ চায়, তার জন্যে এই ব্যবস্থা। লোকে মুখে বলে সাধুতা ও পবিত্রতার কথা। কিন্তু জেনো এ দুটি বস্তু অতি ভীষণ, ভয়ঙ্কর।
পুষ্প বল্লে–বুঝতে পারছি কিছু কিছু। নিজের জীবনে দেখচিনে। কি? তবুও বলুন।
–সাধুতা, পবিত্রতা–শুনতে খুব ভালো। কিন্তু এদের আবির্ভাব বিষয়ী লোকের পক্ষে কষ্টকর। কামনাকলুষিত আধারে ভগবানের জ্যোতি অবতরণ করবে কি ভাবে? এ জন্যে আধার-শুদ্ধির প্রয়োজন। যাকে ভগবান কৃপা করেন, শুদ্ধ আধার করে নিতে তার সব কিছু ভোগ কামনার জিনিস ধ্বংস করে তাকে নিঃস্ব, রিক্ত করে দেন। ভগবানের কৃপা সেখানে বজ্রের মত কঠোর, নিৰ্ম্মম, ভয়ঙ্কর। সৰ্ব্বনাশের মূর্তি ধরে তা আসে জীবনে, ধ্বংসের মূর্তিতে নামে। সে রকম কৃপার বেগ সামলাতে পারে ক’জন?
পুষ্প চুপ করে রইল। এর সত্যতা সে নিজের জীবনে বুঝচে।
ক্ষেমদাস বল্লেন–দ্যাখো, আমি ভক্তিপথের পথিক, তুমি জানো। সন্ন্যাসী যে নির্ণ। ব্রহ্মের কথা বলে, তাঁকে বুঝতে হোলে জ্ঞানের পথ দরকার। জ্ঞান ভিন্ন ব্রহ্মকে উপলদ্ধি করা যায় না। আমি সাকারের উপাসক, মধুর ভাবে মধুর মূৰ্ত্তিতে তাঁকে পেতে চাই–তাই আমি বৃন্দাবনে গিয়ে সেই রস আস্বাদ করি। সন্ন্যাসী বলে, ও অপ্রাকৃত মূৰ্ত্তির উপাসনা কর কেন? আমি বলি, তোমার নিয়ে তুমি থাকো, আমার নিয়ে আমি, থাকি। ও বলে, ব্রহ্ম আবরিত হতে হতে জীব হয়েচে, জীব হয়ে স্বরূপ ভুলে গিয়েচে। ব্রহ্ম দেশ-কালের মধ্যে ধরা দিয়ে জীব হয়েছে। কেন হয়েছে? লীলা। আমি বলি, বেশ, এক যখন বহু হয়েচেন লীলার আনন্দকে আস্বাদ করতে, তখন আমিও তাঁর লীলাসহচর তো? আমাকে বাদ দিয়ে তাঁর লীলা চলে না। এই তো প্রেমভক্তি এসে গেল। কেমন?
পুষ্প বল্লে–বনের সেই সন্ন্যাসিনী কিন্তু প্রেমভক্তির কাঙাল। আমি সেবার রঘুনাথদাসের আশ্রমে নিয়ে গিয়েছিলাম, বৃন্দাবনে নিয়ে গিয়েছিলাম–সেই থেকে গোপাল-বিগ্রহের ভক্ত হয়ে উঠেছেন।
–সে যে মেয়েমানুষ। শুষ্ক জ্ঞানপথে সে তৃপ্তি পায় না–লীলারস আস্বাদ করতে চায়। আমি চল্লাম খুকি, তুমি আজ তো বৃন্দাবনে গেলে না, কাল এসে নিয়ে যাবো। সন্ন্যাসী তোমাকেও কি বলেছিল না?
-বলেছিলেন, এখনও অপ্রাকৃত লোক আঁকড়ে আছে কেন? তোমার। তো উচ্চ অবস্থা, উচ্চস্তরে চলো।
পৃথিবীর হিসাবে আজ কয়েক বছর হোলো পুষ্প এই স্বরচিত বুড়োশিবতলার ঘাটে সম্পূর্ণ একা। করুণাদেবীও ওকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তত উচ্চস্তরে গমন করলে আর। সে পৃথিবীতে যাতায়াত করতে পারবে না বলেই এই গঙ্গার ঘাট আঁকড়ে পড়ে আছে। এই তার পরম তীর্থ–তার মহর্লোক, জন লোক, তপোলোক, সত্যলোক, ব্রহ্মলোক–লোকাতীত পরমপকারণ। পরব্রহ্মলোক। কোথাও পোষাবে না তার। কত সহস্র স্মৃতিতে ভরা এই প্রাচীন ভাঙা ঘাটটি।