ক্ষেমদাস চুপ করলেন।
পুষ্প বল্লে–এ দেশের সেই কবিকে দেখা যায় না?
–এতক্ষণ সে ছিল এখানেই। সেও ভগবানের চারণকবি। এই প্রকৃতির সৌন্দর্য্যের সে স্তবগীত রচনা করে। সে এখন ঘুমিয়েছে।
-–বিবাহিত?
–এ দেশের নিয়ম বুঝি না। স্ত্রীলোকদের অদ্ভুত স্বাধীনতা এখানে। তারা যার ঘরে যতদিন ইচ্ছা থাকে। আবার যেখানে সত্যকার প্রেম আছে, সেখানে পৃথিবীর স্বামী-স্ত্রীর মত আজীবন বাস করে। আমাদের কবির সঙ্গে তিন-চারটি নারী থাকে–কিন্তু তারা কেউই পৃথিবীর তুলনায় সুন্দরী নয়। এদেশের মেয়েরা সুশ্রী নয়। অবশ্য নারী তিনটির সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক জানি না। এদেশে হয়তো তাতে দোষ হয় না। যে দেশের যে নিয়ম।
ওরা কিছুদূরে গিয়ে দেখতে পেলে বনের মধ্যে গাছতলাতে দু তিনটি লোক নিদ্রিত। ক্ষেমদাস বল্লেন–ওই দ্যাখো কবি শুয়ে। ঐ পাশেই তিনটি নারী।
পুষ্প আশ্চর্য হয়ে বল্লে–গাছতলাতে কেন সবাই?
–এখানে লোকের ঘরবাড়ী নেই পৃথিবীর মত। ওদের দেহ অন্য ভাবে তৈরী। রোগ নেই এখানে, হিংস্র জন্তু বা সর্প নেই। দেহের কোনো ক্ষতি হয় না। অল্প আয়ু বলে ঘরবাড়ী করে না কেউ।
–তবে মরে কিসে?
–এদের স্বেচ্ছামৃত্যু। জ্ঞানী ও নিস্পৃহ আত্মা কিনা! নির্দিষ্ট সময় অন্তে যেদিন হয় এরা মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হবে। মন যেদিন এদের তৈরী হবে সেদিন স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করবে। মৃত্যুতে এরা শোক করে না। এরা জানে মৃত্যু দেহের পরিবর্তন মাত্র।
–পুনর্জন্ম?
–এখানে যারা জন্ম নেয়, তারা অনেক জন্ম ঘুরে এসেছে। পৃথিবীতে বহু জন্ম কেটেচে এদের। শেষ জন্ম এখানে কাটায়। তার পরেই মহর্লোকে চলে যায় একেবারে, আর ফেরে না। কিন্তু তুমি একটা কথা বোধ হয় জানো না–পৃথিবীর চেয়ে নিকৃষ্টতর গ্রহও অনেক আছে। নিম্ন শ্রেণীর আত্মাদের পুনর্জন্ম অনেক সময় ওই সব নিকৃষ্টতর। লোকে হয়।
–সে সব স্থান কি রকম?
–একটাতে তোমাকে এখুনি নিয়ে যেতে পারি। চোখেই দেখবে, না কানে শুনবে?
তবে একটা কথা। সে সব দেখে কষ্ট পাবে। মেয়েমানুষ তুমি, সে সব গ্রহলোক দেখলে তোমার মনে হবে ভগবান বড় নিষ্ঠুর।
চক্ষের পলকে ওরা একস্থানে এসে পৌঁছলো। সে স্থানটির সর্বত্র ঊষর মরুভূমি ও কৃষ্ণবর্ণের বস্তুর স্তূপ। কিন্তু সে স্থূপ প্রস্তর নয়–তা কি, পুষ্প জানে না। উলঙ্গ বিকটদর্শন অর্ধমনুষ্যাকৃতি জীব দু’একজনকে সেই কৃষ্ণবস্তু স্তূপের ওপর বসে থাকতে দেখা গেল। মাঝে মাঝে তারা উঠে মাটির মধ্যে হাত দিয়ে গর্ত খুঁড়ে কি বার করচে ও পরম লোলুপতার সঙ্গে মুখে পুরচে।
ক্ষেমদাস বল্লেন–চলো এখান থেকে। ওরা কীটপতঙ্গ খুঁজে খাচ্চে। ওই ওদের আহার। ওই ওদের আহার সংগ্রহ রীতি। একজনের বস্তূপে আর একটি জীব যদি আসে, তবে দুই জীবে মারামারি করবে। এ ওকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করবে। এ জগতে স্নেহ, প্রেম, ভক্তি, ভালবাসা, দয়া, সেবা, ন্যায়বিচার, শিক্ষা, সংগীত কিছু নেই। আছে কেবল দুর্দান্ত আহার-প্রচেষ্টা। জীবে জীবে কলহ।
পুষ্প বল্লে–চলুন এখান থেকে। হাঁপ লাগচে। কি জড় পদার্থে গড়া এ দেশ, প্রাণ যেন কেমন করে উঠলো। এও কি ভগবানের রাজ্য?
ক্ষেমদাস হেসে বল্লেন–এখনও দেখোনি। চলো আরও দেখাই–এর চেয়েও ভয়ানক স্থান দেখবে। যেখানে পিতামাতা পুত্রকন্যার সম্বন্ধ পৰ্য্যন্ত নেই। যেখানে–না সে তোমাকে বলব না।
পুষ্প অধীর ভাবে বল্লে–কেন আমাকে এখানে নিয়ে এলেন? উঃ–বলেই সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে। হাত জোড় করে বল্লে– আমার একমাত্র সম্বল ভগবানে ভক্তি, আর আমার কিছু নেই জীবনে। দেব, দয়া করে সেটুকুও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবেন না–কৃপা করুন–আমি নিতান্ত অভাগিনী!
ক্ষেমদাস হেসে বল্লেন–পাগল! সেই অনন্ত মহাশক্তির এক দিকই কেবল দেখবে? রদ্রদেবের বাম মুখ দেখলেই ভক্তি চটে যাবে অত ঠুনকো ভক্তি তোমার অন্তত সাজে না। তুমি আমি তাঁর উদ্দেশ্যের কতটুকু বুঝি? চলো ফিরি। ওই জন্য আনতে চাইনি তোমাকে এখানে। এতেই এই, এর চেয়েও নিকৃষ্ট লোকে নিয়ে গেলে
-–না দেব। আমায় পৃথিবীতে অন্তত নিয়ে চলুন। আমাদের। পৃথিবীতে–চলুন গঙ্গাতীরে–
মহাশূন্য বেয়ে সেই মুহূর্তে ওরা এসে পৃথিবীতে একস্থানে বৃক্ষতলে দাঁড়ালো। বর্ষাকাল পৃথিবীতে, ভীষণ বৃষ্টি হচ্চে। স্থানটা পাহাড়ে ঘেরা, পাহাড় ঝাঁপসা হয়ে গিয়েচে বৃষ্টির ধারায়।
ক্ষেমদাস বল্লেন–নিয়ে এলাম গঙ্গাতীরে। ওই অদূরে গঙ্গা–
–এটা কোন্ স্থান?
–হরিদ্বার।
পুষ্পের চোখ জুড়িয়ে গেল ধারামুখর অপরাহ্নের বহুপরিচিত, অতি প্রিয় শোভায়। তার মন বলে উঠলো–এই তো আমাদের পৃথিবী, আমাদের স্বর্গ। ভগবান এখানে কত ফুলে ফলে নিজেকে ধরা দেন, কত জ্যোৎস্নার আলোয়, কত অসহায় শিশুর হাসিতে। আজ চিনলাম। তোমায় ভাল করে, আমাদের মাটির স্বর্গকে, আর চিনলাম মানুষকে। মানুষই মাটি দিয়ে গড়া দেবতা–দুদিন পরে সত্যিকার দেবতা হয়ে যাবে। জয় নীলারণ্য-কুন্তলা-অতল-সাগর মেখলা চিরন্তনী সুন্দরী পৃথিবীর। জয় জয় মানুষের। জয় বেণুরবশিহরিতা দিগন্তলীনপ্রান্তর শোভিতা ভূতধাত্রী মাতার।
ক্ষেমদাস বল্লেন–এবার তোমার মন শান্ত হয়েছে। বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। এখন একটা কথা বলি। কি দেখে অস্থির হয়ে উঠলে?
পুষ্প সলজ্জ হেসে চুপ করে রইল। ক্ষেমদাস বল্লেন–না, বলো, বলতেই হবে। ভগবান কি নিষ্ঠুর–এই ভেবেছিলে। না?