ওর মন আর পারে না। অবসন্ন, ক্লান্ত মন যেন বলে ওঠে–ভগবান, আমি আর পারিনে। আমায় বাঁচাও–এ থেকে উদ্ধার করো–
কে যেন ওর কথা শোনে। আশার স্বপ্নাচ্ছন্ন, অবসন্ন মন বোঝে না কে সে। অনেক দূরের, অনেক আকাশের পারের কোন দেশ থেকে সে যেন উড়ে আসে পাখায় ভর করে। একবার আশার মুগ্ধ দৃষ্টির। সম্মুখে যেন এক অনিন্দ্যসুন্দরী, মহিমময়ী দেবীমূৰ্ত্তি ভেসে ওঠে। বরাভয়করা স্মিতহাস্যমধুরা…অপরূপ রূপসী জ্যোতির্ময়ী নারী। আর মনে আছে এক সাদা বড় পাহাড়ের ছবি, সবাই মিলে, তাকে ছুঁড়ে যেন সেই সাদা পাহাড় থেকে বহুদূরে নীচের দিকে ফেলে দিচ্চে।
দেবী যেন হাসিমুখে বল্লেন–যাও, ভাল হও–ভুল আর কোরো না।
কে যেন প্রশ্ন করলে–আশা-বৌদির স্বামীর সঙ্গে মিলবে কি করে? ও তো সব ভুলে যাবে।
দেবী বল্লেন–আমি সব মিলিয়ে দিই। ওরা তো নতুন মানুষ হয়ে চললো, ওদের সাধ্য কি?
তারপর গভীর অতলস্পর্শ অন্ধকার ও বিস্মৃতি। অন্ধকার…অন্ধকার।
পুষ্প একদিন সেই নির্জন গ্রহটিতে একা গেল। ওর বড় কৌতূহল। হয়েছিল বনকান্তার, অরণ্যাণী ও শৈলমালায় পরিপূর্ণ ওই ছায়াভরা। গ্রহের জীবনযাত্রা দেখতে।
এবার রাত্রি নেমেচে গ্রহটিতে।
জীবকুল সুপ্ত। অপূৰ্ব্ব সুন্দর দেশ। বোধহয় ঐ গ্রহে তখন বসন্ত ঋতু। সেই দিদিশাহীন অরণ্যে কান্তারে নাম-না-জানা কত কি বন কুসুম-সুবাস। বনে বলে ছাওয়া সারা দেশ। বনের গাছপালার মধ্যে দিয়ে বেঁকে এসে ওর সাথী তারার নীল জ্যোৎস্না পড়েছে। নৈশ কচিৎ পক্ষ-বিধূনন।
গ্রহের দিকবিদিক সে চেনে না। পৃথিবীতে গেলে তবে উত্তর দক্ষিণ দিক বুঝতে পারে। এ গ্রহের লোকে কাকে কোন দিক বলে কে জানে? কিন্তু এর মাঝামাঝি থেকে একটু বাঁ দিক ঘেঁষে এক উত্তুঙ্গ শৈলশ্রেণী বহুদূর ব্যেপে চলে গিয়েছে, অনেক ছোট বড় নদী এই শৈলগাত্র থেকে নেমে চলেচে নীচেকার বনাবৃত উপত্যকায়। দু-একটি বড় জলপ্রপাত বনের মধ্যে।
ওর আকাশে বাতাসে বনে বনানীতে কেমন একটি শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ আনন্দ। এর বাতাসে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস যে নেবে, সে-ই যেন হয়ে উঠবে। আনন্দময় ব্ৰহ্মদর্শী ভক্ত, ধীর ও নির্লোভ, তৃষ্ণাহীন ও উদার। এর বনতলে জীবের অমরত্বের কথা লেখা আছে, লেখা আছে এ বাণী যে এই বনতলে তাঁর আসন পাতা। উচ্চ জগৎ বটে।
হঠাৎ ও দেখলে একটি বনপাদপের তলে শিলাসনে স্বয়ং কবি ক্ষেমদাস বসে।
ও দেখে বড় খুশি হয়ে কাছে গেল। ক্ষেমদাস বল্লেন–এসো এসো, যিনি আদি কবি, বিশ্বস্রষ্টা, তাঁর বিষয়ে আমি কবিতা রচনা করছি।
–আপনি এ গ্রহ জানেন?
–কেন জানবো না? এ রকম একটা নয়–দীর্ঘ বনফুলের মালার মত একসারি গ্রহ আছে বিশ্বের এ অংশে। আমি জানি। তবে এখানে। আসতে হয় যখন এ গ্রহে রাত্রি।
-কেন?
–এখানকার লোক উচ্চশ্রেণীর জীব। ওরা আমাদের দেখতে পাবে। দিনের আলোয়। এখন ওরা সুপ্ত। ব’সো ওই শিলাসনে। বেশ লাগে। এখানে। লোকালয় এ গ্রহে খুব কম। বনে হিংস্র জন্তু নেই। কেমন। নীল জ্যোৎস্না পড়েচে দেখেছো? বড় ভালবাসি এ দেশ।
–আপনি এখানে আসেন কেন?
–একটি তরুণ কবি আছে এ গ্রহে, তাকে প্রেরণা দিই। ভগবদ্ভুক্ত। এই শিলাসনেই সে খানিক আগেও বসে ছিল। প্রতি রাত্রে নির্জনে এসে বসে। সৃষ্টির এই সৌন্দর্য্যের স্তবগান রচনা করে। ওই তার উপাসনা। তুমি জানো আমারও ওই পথ। তাই তার পাশে এসে দাঁড়াই।
–তিনি দেখতে পান আপনাকে?
–না। আমাকে বা তোমাকে দেখতে পাবে না। তোমার সঙ্গী। যতীনকে দেখতে পেতো। সে এখন কত বড় ছেলে।
পুষ্প সলজ্জভাবে বল্লেন’বছরের বালক।
ক্ষেমদাস হেসে বল্লে–আবার নব জন্মলীলা। বেশ লাগে আমার। আবার মাতৃক্রোড়ে যাপিত শৈশব। চমৎকার!
পুষ্প হেসে বল্লে–সন্ন্যাসী এখানে উপস্থিত থাকলে আপনার কথা মেনে নিতেন?
–জানি, সে বলে বার বার দেহ ধারণ করা মুক্তির পথে বাধা। সে বলে, ও থেকে উদ্ধার নেই। সেই একই জীবনের পুনরাবৃত্তি, চক্রপথে উদ্দেশ্যহীন গতাগতি। সেই একই লোভ, তৃষ্ণা, অহঙ্কার নিয়ে বার। বার অসার জন্ম ও মরণ। এই তো?
–কথাটা কি মিথ্যে?
–না। মানি। কিন্তু সে কাঁদের পক্ষে? যারা জীবনের উদ্দেশ্যকে খুঁজে পায়নি বা ভগবানের দিকে চৈতন্য প্রসারিত করেনি তাদের পক্ষে। যারা জানে না স্থূল দেহের পরিণাম ধূমভস্ম নয়, জন্মের পূৰ্ব্বেও সে ছিল, মৃত্যুর পরেও সে থাকবে, ভূলোকে শুধু নয়, ব্রহ্ম থেকে জীবে নেমে আসতে যে সাতটি চৈতন্যের স্তর আছে, এই সাত স্তরের প্রত্যেকটি স্তরে এক একটি লোক, সে এই সব লোকেরই উত্তরাধিকারী, ভগবানের সে লীলা-সহচর। যারা এ কথা জানে না, জানবার চেষ্টা করে না, জেনেও গ্রহণ করে না বিষয়ের মোহে–তাদের। পক্ষে সন্ন্যাসীর কথা পরম সত্য। কিন্তু আমার পক্ষে নয়।
পুষ্প একমনে শুনছিল। এই পবিত্র গ্রহের তপোবনসদৃশ অরণ্যকান্তারে এ দেশের ঋষিকবিরা যেখানে নিদ্রাহীন গভীর রাত্রে ভগবানের স্তবগাথা রচনা করেন–এ গ্রহের উপনিষদ জন্ম লাভ করে তাঁদের হাতে–এই স্থানই ক্ষেমদাসের উপদেশ উচ্চারিত হবার উপযুক্ত বটে। পুষ্প ব্যগ্ৰসুরে বল্লে–বলুন, দেব, বলুন–উপযুক্ত বটে। পুষ্প ব্যগ্ৰসুরে বল্লে–বলুন, দেব, বলুন–
ক্ষেমদাস আবার বল্লেন–তমেব বিদিত্বাতিমৃতুমেতি–যে তাঁকে জেনেচে সে দেহধারণ করেও মুক্ত, যেমন দেখেছিলে সন্ন্যাসীর গুরুভ্রাতাকে, বন-মধ্যস্থ সেই সন্ন্যাসীকে। যাঁদের চৈতন্য জাগ্রত হয়েচে, দেহ থেকেও তাঁরা জীবন্মুক্ত। ভগবানকে যারা ভালবাসে মনপ্রাণ দিয়ে, দেহধারণ করেও তাঁরা জীবন্মুক্ত। তাঁরা জানেন এই বিশ্বের সমস্ত গ্রহ, সব তারা, সব বসন্ত, সব জীবলোক আমার। আমি এদের মাধুৰ্য্য উপভোগ করবো। তাঁর সৌন্দর্য্যের স্তবগান রচনা করে যাবো। আমি তাঁর চারণ-কবি। আমি ছাড়া কে গান গাইবে এই বিশ্বদেবের অনন্ত সৌন্দৰ্য-শিল্পের? তাঁর গান গেয়েই যুগে যুগে অমর অজর হয়ে আমি বেঁচে থাকবো। শত জন্মের মধ্যেও যদি তাঁর সেবা। করে যাই আর আসি আমার তাতে ক্ষতি কিসের?