–কেউ খাচ্চে না। কেউ বাজার করছে না। সব মিথ্যে, সব স্বপ্ন!
কিন্তু নেত্যনারাণের চোখের বিস্ময়ের দৃষ্টি এত অকপট যে, নিজের বিবেচনার ওপর আশা আস্থা হারালে। নিজে যা বলতে চাইছিল, শেষ করতে পারলে না। মিনতির সুরে বল্লে–আচ্ছা নেত্যদা, তোমার কি মনে হয়? এমন কেন হচ্চে বলতে পারো? এ সব কি? সত্যি না স্বপ্ন?
–তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
-–তাই বলে কি তোমার বিশ্বাস?
–নইলে আবোল-তাবোল বকবে কেন? স্বপ্ন কিসের? আমি রইচি, আমি হাটবাজার করচি, খাচ্চি দাচ্চি–সব স্বপ্ন হোল কি ভাবে? এই ঘরবাড়ী দেখতে পাচ্চ না?–বাড়ীউলি মাসী, ও বাড়ীউলি মাসী–শুনে। যাও এদিকে। কি বলচে শোনা ও!
বাড়ীউলি মাসী বল্লে–কি গা?
-–ও বলচে এ সব নাকি মিথ্যে। তুমি ঘরবাড়ী, এই বিছানা–সব স্বপ্ন!
কি জানি বাপু, ও সব তোমরা বসে বসে ভাবো। আমাদের খেটে খেতে হয়, শখের ভাবনা ভাববার সময় নেই। বেলা হোল দুপুর, উনুনে আঁচ পড়েনি। পালেদের বৌ সেই কোন্ সকালে একবাটি চা খাইয়েছিল ডেকে। যাই–
নেত্য ওর দিকে চেয়ে বল্লে–শুনলে?
আশা বোকার মত শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে হতাশ ভাবে বল্লে–কি জানি। বাপু! আমার যেন এক এক সময় মনে হয় এই স্বপ্ন দেখচি তুমি আর আমি। এ ঘর নেই, বাড়ী নেই, খাট নেই, বিছানা নেই–ওই রাস্তা, লোকচলাচল সব মিথ্যে, সব স্বপ্ন। কেবল তুমি আর আমি আছি– আর এই যে সব দেখচি সব স্বপ্ন দেখচি আমরা দুজনে।
-বা রে, বাড়ীউলি মাসী এলো, কথা বলে গেল, ও-ও কিছু নয়?
পরে বিভ্রান্তকে বোঝাবার সুরে সদয়ভাবে বল্লে–এ সব তোমার। মাথার ভুল। সব সত্যি–দেখচো না বাড়ীউলি মাসী এসে কি বলে গেল। একবার তোমাকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাওয়াতে হবে। রাত্তিরে ভাল ঘুম হচ্চে না, না কি?
আশা বল্লে–তবে মাঝে মাঝে পাই আবার হারাই কেন?
অনেকটা অন্যমনস্ক সুরে কথাটা বলে ফেলেই ও চাপতে চেষ্টা করলে। বল্লে–কি জানি, যা বলচো, তাই বোধ হয় হবে। আচ্ছা আমরা এখানে কতকাল থাকবো? চলে যাবো এখান থেকে।
–কেন যাবো? বেশ আছি।
–আমাকে আমার গাঁয়ে রেখে এসো–লক্ষ্মী?…
নেত্য রেগে উঠে বল্লে–মেরে হাড় গুঁড়ো করবো। সেই শম্ভু বাঁদরটার জন্যে মন কেমন করচে বুঝি? আমি সব জানি।
–না না, সত্যি না নেত্যদা। তোমার দুটি পায়ে পড়ি। আমার এখানে থাকতে ভাল লাগছে না। ভয় হচ্চে। মনে হচ্চে যেন এমন জায়গায় এসে পড়েচি, এখান থেকে বেরুবার পথ নেই। এই ছোট্ট ঘরটা, ওই তক্তপোশটা…এ বাড়ীর যেন চারিদিকে দেয়াল দিয়ে আমাদের কে আটকেচে। এখান থেকে কেউ বেরুতে দেবে না। এ সবও সত্যি নয়, এ সব মিথ্যে, সব ছায়াবাজি। যা এই সব দেখচি না?…সব ভুল।
নেত্য ব্যঙ্গের সুরে বল্লে–আবার আবোল-তাবোল বকুনি? মাথা কি একেবারে গেল?
আশা আপন মনেই বলে যাচ্ছিল–এ থেকে তোমার আমার কোনোদিন উদ্ধার নেই। জানো, আমি অনেক চেষ্টা করেচি পালাবার, বাইরে যাবার। কিন্তু পারিনি–কে আবার এই সবের মধ্যে আমায় এনে ফেলেচে। অথচ আমি চাই উদ্ধার পেতে এ সব থেকে, এখান থেকে অনেক দূরে চলে যেতে–যেখানে এসব নেই। কেন পারিনে। জানো? অনেক চেষ্টা করেছি আমি পালাবার-পারিনি।
আশা অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়লো। নেত্য না-বোঝার দৃষ্টিতে ওর। দিকে চেয়ে রইল উদ্বিগ্নভাবে।
নেত্য নানারকম অত্যাচার শুরু করলো ক্রমে ক্রমে আশার ওপর। ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখে, মারধর তো করেই। বাড়ীউলি মাসী যোগ দিয়েচে নেত্যদার দিকে। ওকে বলে–বল্লম, এক মারোয়াড়ী বাবু জুটিয়ে দিচ্ছি–তা হোল না। লোকে কি যার সঙ্গে বেরিয়ে আসে, তার সঙ্গেই ঘর করে চিরকাল? কত দেখুন আমার এ বয়সে। ওই যে পাশের বাড়ীর বিন্দি, আপন দেওরের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল, তা কই এখন? কোথায় গেল সে রসের নাগর দেওর? নোয়াওলা খোট্টা বাবু রাখেনি ওকে? কেমন ছাপর খাট, গদি, এক পিরুস্তুত রূপোর বাসন! দুপয়সা গুছিয়েছে–
কি ঝকমারি করেচে আশা। এই কথাবার্তা তার গাঁয়ে ছুঁচের মত বেঁধে আজকাল। কেউ ভাল কথা যদি বলতো দুটো এখানে। কাল ঢেলে ঢেলে তার সারা গায়ে কালি মাখিয়ে দেয় এরা।
কিন্তু কাটলো বহুঁকাল। অনেক দিন, বৎসর, মাস–অনেক জীবন, জন্ম মৃত্যু যেন জড়িয়ে এক হয়ে গিয়েছে। সত্যিতে স্বপ্নতে জড়িয়ে এক হয়ে গিয়েচে। এক শক্ত হয়ে পাক জড়িয়ে গিয়েছে এবং আরও যাচ্ছে দিন দিন যে, কেউ খুলতে পারবে না। একদিন সে আফিং আনিয়ে নিল পালেদের ছেলের হাত দিয়ে। সেদিন নেত্যনারাণ কোথায় বেরিয়েছে–ভালোই হয়েছে, একেবারে সব যন্ত্রণার অবসান সে আজ করবে। ঘরে খিল দিয়ে শুয়ে রইল আফিং খেয়ে–তারপর ক্রমে ঝিমিয়ে পড়লো। পেটে কোথায় যেন ভীষণ বেদনা করচে সব যন্ত্রণার। আজ একেবারে শেষ হবে। সকলের মুখে অশ্লীল কথা শুনতে হবে। কিন্তু কোথা থেকে নেত্যনারাণ ফিরে এসে ওর ঘরের দোর ভেঙে খিল খুলে ওর মাথার চুল ধরে সারা বারান্দা হাঁটিয়ে বেড়াতে লাগলো। কিছুতেই ওকে বসতে দেয় না, গালে চড় মারে–বলে–বসতে চাও? ন্যাকামি করে আবার আফিং খাওয়া হয়েছে–ওঠো বেঁচে, তারপর তোমার হাড় আর মাস–
বাড়ীউলি মাসী কোন্ ফাঁকে কাছে এসে চুপি চুপি বলে–বন্ধু বাপু, দিব্যি মাড়োয়াড়ী বাবু জুটিয়ে দিচ্চি। অমন কত হচ্চে আজকাল। কেন মিছিমিছি আফিং খেয়ে কষ্ট পাওয়া?…দিব্যি সুখে থাকবে। ওই পাশের বাড়ীর বিন্দি। ছাপর খাট, কলের গান, বাসনকোসন। ও যে। আপন দেওরের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল–