–ভাই, এ সত্য না স্বপ্ন?
–কেন রে?
–আজকাল আমার কি যে হয়েছে, কোটা স্বপ্ন, কোটা সত্যি বুঝতে পারিনে। দুটোতে কেমন যেন জড়িয়ে গিয়েছে।
–না ভাই। ওই সেই দুর্গাপিঁড়ি-পাতা কাঁটালতলা। আমাদের ইতুপূজোর ঘট ওখানে সাজানো আছে। এখন সন্দেহ গেল রাজকুমারী?
–ঠাট্টা করিস নি। আমার ভয়-ভয় করে সর্বদা। কি হয়েছে আমার। বলতে পারিস?
–তোর মাথা হয়েছে। নে, আয় দুটো মুড়ি আর ফুট কলাই ভাজা খা। তুই ভালবাসিস্–মনে আছে?
-খুব।
সারাদিন দুই সইএ কত গল্পগুজব কতকাল পরে। সব ভুলে গিয়েছে আশা–সে পবিত্র, পবিত্র। সামনে তার সুদীর্ঘ জীবন পড়ে আছে। সইএর সঙ্গে গল্পে কত ভবিষ্যৎ জীবনের রঙীন স্বপ্ন আঁকে সে রজনী ডাক্তারের বাগানের বাতাবীলেবুতলার ছায়ায় বসে। শ্বশুরবাড়ী হবে পাড়াগাঁয়ে বড় গেরস্থ ঘরে, আট দশটা ধানের গোলা থাকবে বাড়ীতে, সে বাড়ীর বৌহিসেবে সন্ধ্যাপ্রদীপ দেখাবে গোলার সামনে। বেদীতে…ধান মেপে মেপে গোলায় তুলবে। স্বামী হবে উঁকিল বা ডাক্তার। সারাদিন পরে খেটেখুটে এসে বলবে–ও বড় বৌ–আলো দেখাও–
বীণা হাসে। সেও তার মনের কথা বলে।
গ্রামের একটি ছেলেকে সে ভালবাসে। যদি তার সঙ্গে বিয়ে হয়–
ও সব কথা কেন? ও কথা সে শুনতে আসেনি। তবুও সে জিজ্ঞেস করলে–কে ভাই ছেলেটি?
–ব্রাহ্মণ। সত্যনারাণ চাটুয্যের মেজছেলে। তাকে দেখাবো একদিন।
যতক্ষণ সে সইএর বাড়ী রইল, সে হয়ে গেল একেবারে ঠিক তেরো চোদ্দ বছরের সরলা মেয়েটি। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে এল। কাঁটালতলায় ছায়া পড়লো, রাঙা রোদ একটু একটু দেখা যায় গাছের তলায়। এ সময়ে আশাকে বাড়ী ফিরতে হবেই।
সইকে বল্লে–আমার সঙ্গে একটু এগিয়ে চল না আমাদের বাড়ী পৰ্য্যন্ত সই।
–চল এগিয়ে দিয়ে আসি
বাঁশবাগানের তলা দিয়ে অন্ধকার সন্ধ্যার পথে দুই সইএ চলেছে। ওই জামাইবাবুদের বাড়ীটা। বড়দি এতক্ষণ চা করে নিয়ে বসে আছে। ওর জন্যে।
বীণা বল্লে–ওই তোদের বাড়ীর দরজাটা–আমি চলি সই। এর পরে একলা যেতে পারবো না
বীণা চলে গেল অন্ধকার বাঁশবনের পথটা দিয়ে একা একা। আশা সইএর অপস্রিয়মাণ মূৰ্ত্তির দিকে চেয়ে রইল–তারপর যখন আর দেখা গেল না তখন সামনের দিকে চেয়েই ভয়ে ওর বুক কেঁপে উঠলো কি ওখানে?
ও চীৎকার করে ডাক দিলেও সই–ও বড়দি–
ওর সামনে বাড়ীউলি মাসীর দরজা, যে দরজাটা খুলে সকালে আজই পালিয়ে গিয়েছিল লুকিয়ে। ওর চীৎকার শুনে দরজাটা খুলে নেত্যনারাণ দুপাটি দাঁত বের করে এগিয়ে এসে বল্লে–বাপরে! কি তোমার কাণ্ড! কোথায় গিয়েছিলে সারাদিন?…
তার পর ওর হাত ধরে টানতে টানতে বলে–চলো, চলো, রাত হয়ে গিয়েছে–শোবে এসো, শোবে এসো…
কতকাল যে কেটে গেল মানিকতলার বাড়ীউলি মাসীর সেই বাড়ীটাতে। তার কোন হিসেব নেই, কোনো লেখাজোখা নেই–আশার মনে হয় বাল্যকাল থেকে তার বিবাহের সময়, তারপর তার সমস্ত বিবাহিত জীবন নিয়ে যতটা সময়ের অভিজ্ঞতা তার আছে–তেমনি কত বাল্যজীবন, কত বিবাহিত জীবন, কত বৈধব্যজীবন এবং কত মানিকতলার জীবন তার কেটে গেল–সে কিন্তু সেই এক ভাবেই রইল একই জায়গায় স্থাণুবৎ অচল।
নেত্যদা তাকে ছাড়ে না। কতবার সে পালিয়ে গিয়েছে–জীবনের। কত জানা অজানা কোণে। কত বছরের ব্যবধান রচনা করচে সে বর্তমান জীবনের ও সেই সব অতীত দিনের শান্তি ও পবিত্রতামণ্ডিত অবকাশের।
কিন্তু কোনো ব্যবধান টেকে না।
সব এসে মিশে যায় বর্তমানের এই কলকাতা মাণিকতলার বাড়ীউলি মাসীর বাড়ীর দরজায় এই ঘরটাতে, ওই তক্তপোশটাতে।
এখন যেন মনে হয়–এসব যা ঘটেছে, এ আসল নয়, সব যেন। অবাস্তব, স্বপ্নবৎ…এ সব ছায়াবাজি জীবনটাই যেন একটা মস্ত ছায়াবাজি হয়ে গেল তার…
সই, মা, ভাই, বোন, স্বামী, ছেলে-মেয়ে কিছুই নিত্য নয় তার জীবনে… আসে আবার চলে যায়…বাড়ীউলি মাসীর এ বাড়ীটাই কি এদের মধ্যে একমাত্র সত্যি? আর নেত্যদা, আর এই সরু রান্নাঘরটা… আর ওই ছোট ঘরের ছোট তক্তপোশটা? এর কি কোনো শেষ হবে না, এ দিনের এই সব টিকে থেকে যাবে চিরকাল?
কোটা সত্যি, কোটা স্বপ্ন আজকাল সে বুঝতে পারে না। যেটাকে সত্যি ভেবে হয়তো আঁকড়াতে যায়–সেটাই মিথ্যে হয়ে স্বপ্ন হয়ে যায়। তার কি কোনো রোগ হোল? এমন সাধের, এমন আদরের এমন আশা-আনন্দের জীবনের শেষকালে এ কি ঘটলো? কোথায় চলে গেল স্বামী, কোথায় গেল বাপের ভিটে, শ্বশুরের ভিটে, এ কিভাবে পাগল বা বুদ্ধিহীন কিংবা রোগগ্রস্ত অবস্থায় সে পড়ে রইল?
নেত্যনারাণ এসে বল্লে–রান্না করবে না আজ? বসে আছ যে–
–আমি জানিনে। তুমি আমায় বিরক্ত করতে এসো না
–কেন, আজ আবার রাজরাণীর কি মেজাজ হোল?
–তুমি চলে যাও এখান থেকে
নেত্যনারাণ ওর কাছে এসে বল্লে–বড় ঠাট্টা কর তুমি মাঝে মাঝে। কোথায় যাই বল তো? এখন আমি চলে গেলে তুমি খাবে কি? রূপের ব্যবসা যে খুলবে, সে আর হবে না। আয়নাতে চেহারাখানা দেখেচো এদানিং?
আবার কি-সব যাচ্ছেতাই কথা। অনবরত অপবিত্র অশ্লীল ধরনের এই সব কথা কেন তাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সৰ্ব্বদা শুনতে হয়। ও ভেবে ভেবে বল্লে–আমরা তো মরে গিয়েচি–খাবার আর দরকার
নেত্যনারাণ ওর দিকে চেয়ে বল্লে–মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? তবে খাচ্চ কেন? রোজ রোজ রান্নাবান্না করছো কেন? বাজার করচি কেন?