আশা কলের পুতুলের মত ঘরের মধ্যে গিয়ে বিছানাটিতে শুয়ে পড়লো। ওর সব্বশরীর ঘৃণায় রি রি করছে, বমি হয়ে যাবে যেন এখনি। সমস্ত দেহ মন যেন অপবিত্র হয়ে গিয়েচে ওর, সকালে উঠে গঙ্গায় একটা ডুব দিয়ে না এলে এভাব যেন যাবে না। যাবে সে। গঙ্গাস্নানে–ভোরে উঠেই যাবে বাড়ীউলি মাসীকে নিয়ে।
নেত্যনারাণ ঘরে ঢুকে দোরে খিল বন্ধ করে দিলে।
আশা অসহায় আর্ত সুরে বলে উঠলো–ওকি! খিল দিলে যে?
নেত্য ওর দিকে চেয়ে কড়া, নীরস কণ্ঠে বলে উঠলো–কী ন্যাকামী করচো সন্দে থেকে! সরে শোও, ওপাশে যাও!
আশা বিদ্রোহিণীর ভঙ্গিতে বিছানাতে উঠে বসে বল্লেখিল খুলে দাও বলছি। আমি থাকবো না এ ঘরে। আমি তোমার সঙ্গে থাকবো না এক ঘরে-বাড়ীউলি মাসীর সঙ্গে শোবো
নেত্যনারায়ণ ভীষণ রেগে আশার চুলের মুঠি ধরে বিছানায় ঘুরিয়ে ফেলে দিয়ে বাজখাঁই সুরে বল্লে–তোর মেয়েমানুষের না নিকুচি করেছে–ভালো কথার কেউ নও তুমি! যত বলচি রাত হয়েচে শুয়ে পড়। তোমার হাড় ভেঙে চূর্ণ করবো বেশি নেকুগিরি যদি করবি। ভুলে গিইচিস্ নেত্যনারাণকে হাত ধরে একদিন বেরিয়ে এসেছিলি মনে নেই? সেদিন কে আশ্রয় দিত তোকে, আমি যদি না এখানে। আনতাম! কোন্ বাবা ছিল তোর সেদিন?
–খবরদার, বাবা তুলো না বলচি–আমি চলে যেতে চাই এখান। থেকে।
–তবে রে বেইমান মাগি তোকে মজা না দেখালে
কথা শেষ না করেই নেত্যনারাণ আশাকে আথালি-পাথালি কিলচড় মারতে লাগলো। খাট থেকে মেজের ওপর ফেলে দিলে তলপেটে লাথি মেরে—
কেউ নেই কোনো দিকে। আশা মেজের ওপর গড়িয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো, আৰ্ত্ত অসহায় সুরে–ওর বেদনার্ত পশুর মত চাপা রুদ্ধ চীৎকারে মাণিকতলার বাড়ীউলি মাসীর বাড়ীটা কেঁপে কেঁপে উঠেছিল যেন। কেন এমন হোল? সে যে ভাল হোতে চেয়েছিল, সে যে সব ভুলতে চেয়েছিল, সে যে শ্বশুরবাড়ীতে গিয়েছিল প্রথমযৌবনের বিবাহিত দিনের স্মৃতিমধুর অবকাশে…সেই মাধবী রাত্রির শুভ আহ্বান কেন এ কলঙ্কিত বাড়ীর কলঙ্কিত শয্যাপ্রান্তে উপপতির নিষ্ঠুর আহ্বানে পরিণত হোল? হা ভগবান!
পরদিন সকালে উঠে আশা ছুট দিলে বাড়ী থেকে বেরিয়ে।
কেউ ওঠেনি বাড়ীতে। বাড়ীউলি মাসী ঘুমুচ্ছে, পাশের ঘরে পাল মশাই এরা ঘুমুচ্চে…এই ফাঁকে খিল খুলে আশা পালাচ্চে সুপ্ত কলকাতা শহরের রাস্তা দিয়ে। সে কোথায় যাচ্ছে, কি বৃত্তান্ত কিছুই জানে না। গতরাত্রির অপবিত্র স্মৃতিতে ওর গা ঘিন ঘিন করচে…না, আর এসব নয়। তাঁকে ভালো হতে হবে। সে চায় না এ পাপ সঙ্গ। উপপতির আসঙ্গলিপ্সা তার মন থেকে মুছে ধুয়ে গিয়েচে কবে, বমি হয় সে কথা। ভাবলে, মরার পরেও যেন গা বমি বমি করে। যতদূর হয় চলে যাবে, গঙ্গাস্নান করে শুদ্ধ হবে, এ পাপপুরীর ত্রিসীমানায় আর সে আসবে না। ভগবান তাকে রক্ষা করুন। সে বেঁচে নেই, যেখানে খুশি সে। যেতে পারে। কলকাতা শহর অনেকদূরে মিলিয়ে গেল।
পৃথিবীর পাপস্মৃতি আর তাকে কষ্ট দেবে না। অনেকদূরে সে চলে এসেচে বাড়ীউলি মাসীর কাছ থেকে। এ তার শৈশবের নিষ্পাপ দিনগুলিতে সে ফিরে গিয়েছে।
সে যেন তাদের গ্রামে মুখুয্যেদের পুকুরপাড়ে নিতাই ভড়দের বাড়ী নিতাই ভড়ের মেয়ে সুবির সঙ্গে খেলা করতে গিয়েচে। ঐ তাদের। পাড়ার পুকুরপাড়ের সেই বড় তেঁতুলগাছটা। ওই নিতাই ভড়ের বাড়ীর উঠোনের ধানের গোলা। নিষ্পাপ, সুন্দর শৈশবকাল। এখানে শুধু তার মাকে সে জানে, কোনো স্মৃতি তার মনে নেই–হেমন্তের প্রথম শিশিরার্ড গ্রাম্য মাঠে নব ধান্যগুচ্ছের আন্দোলনের মত তার জীবনের আনন্দে চঞ্চল, ঝরা শিউলিফুলের সুবাস সুরভিত জীবনের অতি মধুর প্রভাত।
-সুবি–ও সুবি–খেলবিনে আজ, বাইরে আয় ভাই–
সুবি বাইরে এসে বল্লে হাসিমুখে–আশাদি, কোথায় ছিলি রে? ক’দিন খেলতে আসিসনি–
আশা খুশি হোল। এ তার সত্যিকার শৈশব। সে বেঁচে গেল। এই তার সুন্দর, মধুর আশ্রয়। তার মা–এখুনি তার মা ডাকতে আসবে। তাকে। খুশির সুরে পরম নির্ভরতার সঙ্গে আশা ডাকলে সুবিকে। সুবি ছুটে এল, ওর হাতে একটা পেঁপের ডাল।
–কি হবে রে পেঁপের ডাল?
–বাজাবো। এই দ্যাখ
সুবি পেঁপের ডালের ফুটোতে মুখ দিয়ে পোঁ পোঁ করে বাজাতে লাগলো।
আশা হাততালি দিয়ে হেসে উঠলো খুশি হয়ে। কি মজা! কি মজা!
সুবি বললে–চল, মুখুয্যেদের নন্দিনী দিদি শ্বশুরবাড়ী থেকে এসেচে–দেখে আসি।
–না ভাই, মা বকবে।
–বাড়ীতে বলে আয় না? নন্দিনী দিদিকে দেখেই চলে আসবো
–চল তবে। কিন্তু ভাই দেরি করা হবে না–
ওরা কত জায়গায় খেলা করে বেড়ালে। বনমূলো-ফুলের বড়া ভেজে খাওয়ার অভিনয় করলে।
শৈশবের অতিপরিচিত সব খেলার জায়গা। নন্দিনী দিদি কত বড়, ওদের মায়ের বয়সী, এদের দুজনের আর কি বয়সটা? নদীর ওপর। মেঘ আসছে, কতদূর থেকে অকালবর্ষার মেঘ, ভেসে আসচে আকাশ ভরে। হেমন্তে কাশ ফুলের শোভা।
সুবি বল্লে–বেলা বেশি হয়েছে–বাড়ী ফিরি–
–হ্যাঁ চুল ভাই-মা বকবে–
মা তাকে বকবে সে জানে। টক কাঁচা তেঁতুল খাওয়ার জন্যে বকবে, এতক্ষণ বাইরে থাকার জন্যে বকবে। তারপর রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে ওকে খাইয়ে দেবে। উত্তরের ঘরে ওর জন্যে মাদুর পেতে অন্নপূর্ণা দিদি ছেলেমেয়ে নিয়ে শুয়ে আছে। খেয়ে গিয়ে অন্নপূর্ণা দিদির পাশে ও শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।