রামলাল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বল্লেনাঃ–বামুনের মেয়ে।
–আবার কি?
-ওই যে সাদা কোঠাবাড়ীটা–ওই বাড়ী থেকে রোজ বেরিয়ে পুকুরঘাটে নায়। বামুনবাড়ী।
–তাই হয়েছে কি?
–ষোল সতেরো বছর বয়েস। দেখবে?..এসো, এসো–এতক্ষণ নামচে জলে। নামটি বেশ, সন্ধ্যারাণী। ফর্সা, একরাশ চুল, একটু পরে ভিজে কাপড়ে নেয়ে বাড়ী ফিরবে। মুখোনি বড় চমৎকার। ছিপছিপে লিকলিকে সরু বেতের মত হেলে পড়ে পড়ে। মুক্তোর মত ঝক্ঝক্ করে দাঁতগুলো যখন হাসে। সব্দদাই হাসছে।
–তাতে তোমার কি?
–আমার কিছু না। বামুনের মেয়ে। ওরা মুখুয্যে।
–মরে গিয়েচ যখন আবার বামুন শুদুরই বা কি? ওতে কি তোমার লাভ?
রামলাল জিভ কেটে দুহাত তুলে নমস্কার করে বল্লে–বাপূরে! ও কথা বলতে নেই। বামুন জাত! আমরা হলাম তেলি তালী। আমি শুধু চোখে দেখেই খুশি। আমার ও সব উঁচু নজর নেই দাদা। সোনামণির হেঁসেলে বসেই আমার সব। ওকে পেয়েই আমার বেশ চলে যাচ্ছে।
–পেলে আর কি করে তা তো বুঝলাম না।
–ওরই নাম পাওয়া। দেহে নেই, কি করবো বলো। সত্যি, একটা কথা দাদা। পৃথিবীতে জন্মাবার কৌশলটা বলে দিতে পারো? দেহ ধরলে কোনো সুখ নেই। মেয়েদের ভালো করে পাইনি জীবনে। ওদের না পেয়ে জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে আমার।
–কেন, তুমি তো বিয়ে করেছিলে?
রামলাল বিরক্তির সঙ্গে মুখ খিঁচিয়ে বল্লে–আরে দূর, বিয়ে!–সে ওই বুড়োটার পাল্লায় পড়ে। নাতবৌএর মুখ না দেখে নাকি মরবে না! আমার ঘাড়ে যা তা একটা চাপিয়ে দিয়ে বুড়ো তো পটল তুলো। আজকাল কেমন সব স্কুলে কলেজে পড়া মেয়ে দেখিচি কলকাতায়। তাদের শাড়ী পরবার কায়দাই আলাদা। কথাবার্তার ধরনই আলাদা। না সত্যি যতীনদা, তুমি আমার যথার্থ উপকার করবে, আমায় জন্ম নেওয়ার কৌশলটুকু বলে দাও দাদা। মেয়েমানুষের সঙ্গে দুদিন প্রাণভরে ভালবাসা করে মিলেমিশে আসি দুনিয়াতে ফিরে। আমার বুকের ভেতরটা সৰ্ব্বদা হু হু করে দাদা। ও জিনিসটা আমি জানিনি– সত্যিকার মেয়েমানুষ পাইনি। স্বগে টগগে তোমরা যাও–আমি তো কারো কোনো অনিষ্ট করতে চাইচিনে ভাই। আমার নেয্য অধিকার চাইচি। সবাই দিব্যি কত ফুর্তি করচে–আমি অল্পবয়সে মরে গেলুম, যে বয়সে ভোগ করার কথা সেই বয়সে। আমার একটা হিল্লে করো, তোমার পায়ে পড়ি দাদা। মেয়েমানুষ না পেলে স্বগৃগে গিয়ে আমার কোনো সুখ হবে না। বুড়োটার সঙ্গে দেখা হোলে তাকেও বোলো। তিনি এখন আসেন আমায় উপদেশ দিতে! তুমি জানো, বিয়ের আগে বন্ধু পালের মেয়ে সরলার সঙ্গে আমার একটু ভাব হয়েছিল। মেয়েটা কেষ্টনগরে মেয়ে-ইস্কুলে পড়তো। দুবার আমার সঙ্গে লুকিয়ে আলাপ করেছিল! টাকা পাবে না বলে ঐ বুড়ো সেখানে আমার বিয়ে দিতে চাইলে না! সেও দিব্যি মেয়ে ছিল।
–এখন সে কোথায়?
–কেষ্টনগরে বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ী থাকে। আমি সেদিন গিয়ে একবার দেখে এসেছি। কষ্ট হয় বলে যাইনে। তার চেয়ে আমার সোনামণিই ভালো। কি চমৎকার একটি তিল ওর নাকের বাঁ-দিকে– দেখনি?..চল্লে? তাহলে–শোনো শোনো–তোমাদের তো অন্তর্ধান হোতে সময় লাগে না একমিনিটও। এই আছো এই নেই। তোমরা হলে স্বগগের মানুষ। তাহলে–আমার একটা উপায়–
যতীন ততক্ষণে বুড়োশিবতলার ঘাটে এসে পৌঁছেচে। পুষ্পের প্রশ্নের উত্তরে বল্লে–হোল না। একেবারে বুভুক্ষু আত্মা। ওকে পুনর্জন্মে পাঠাবার ব্যবস্থা করো পুষ্প। মেয়েমানুষের কথা বলতে অজ্ঞান। ভোগ না করলে ওর নারীতে আসক্তি যাবে না।
পুষ্প হেসে বিজয়িনীর মত দর্পিত সুরে গ্রীবা বাঁকিয়ে বল্লে–স্বর্গে মেয়েমানুষের অভাব? যদি বলো আজই তাকে দেখিয়ে দিয়ে আসি কাকে মেয়েমানুষ বলে! করুণাদেবীকেও নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিই– মূর্ছা হয়ে পড়ে যাবে তক্ষুনি।
যতীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর বিদ্যুল্লতার মত অপূৰ্ব্ব কান্তির দিকে চেয়ে বল্লে–তুমিই যথেষ্ট। আর তাঁকে নিয়ে যেতে হবে কেন। মূচ্ছা তো দূরের কথা, একদম পাগল হয়ে ক্ষেপে যাবে। কিন্তু তার দরকার নেই। বিভ্রান্ত করে দেওয়া হবে, উপকার কিছু হবে না তাতে।
পুষ্প কৃত্রিম রাগের সুরের রেশ তখনও টেনেই বল্লে–না, আমার রাগ হয়েছে শুনে যে, সে মূর্খ বলে স্বর্গে নারী নেই! নারীকে খুঁজতে যেতে হবে পৃথিবীতে।
–তোমরা চোখ ধাঁধিয়ে বেচারীকে পাগল করেই দিতে পারো, কিন্তু সে যা চায় তা দেবে কোথা থেকে? ওকে পাঠিয়ে দাও পৃথিবীতে। একজোড়া আগ্রহভরা কালো ভ্রমরচোখের চাউনি ওর দরকার হয়েছে।
–আচ্ছা, যতুদা, আমি যদি ওকে একেবারে আজন্ম ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসী করে দিতে পারি?
–জন্ম নেওয়ার পরে?
পুষ্প হাসি হাসি মুখে বল্লে–হ্যাঁ। নয়তো কি, এখানে?
–কিলিয়ে কাঁটাল পাকানো দরকার কি? আত্মাকে তার স্বাভাবিক পথে তার স্বাভাবিক গতিতে যেতে দাও।
–এই কথাটিই আশা-বৌদির বেলা তুমি এতদিন বুঝতে চাইতে যতুদা। অপরের বেলাতে বেশ তো বুঝলে।
যতীন চুপ করে রইল।
ওপারের হালিসহরের শ্যামাসুন্দরীর মন্দিরে সন্ধ্যার আরতিধ্বনি শোনা গেল। গঙ্গার বুকে সান্ধ্য আকাশের প্রতিচ্ছবি।
সেদিন আশা একা পাথরের ওপরে বসে খুব কাঁদছিল।
একজন বিকটাকৃতি সাধুপুরুষের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল একদিন এই মরুভূমির ও পাহাড়ের দেশে। তিনি ওকে বলেচেন–পৃথিবীর মৃত্যুর পরে সাত লোক, প্রত্যেক লোকে আবার সাতটা স্তর। প্রত্যেক বার মানুষকে মরে নতুন দেহ ধরে নতুন স্তরে জন্ম নিতে হয়–ইত্যাদি। আশার মাথায় ওসব জটিলতা ঢোকে না–এক এক সময়ে সে বেশ বুঝতে পারে। সে মরেই গিয়েছে বটে। কিন্তু মরেও তো নিস্তার নেই, দুবার তো মরা যায় না–না হয় আবার চেষ্টা করে দেখতো। কোথায় গেল মা, বাবা, স্বামী, ছেলেমেয়ে–এ কি বিশ্রী জীবন, না আছে আশার আলো, না আছে আনন্দ, না আছে ভালবাসা, স্নেহ, দয়া। কেন মিছে বেঁচে থাকা? অথচ মরতেও তো পারে না। এ কি বন্ধন!