–যাবো, আমায় নিয়ে যাবেন। একটি গৃহস্থের বৌ আছে, বড় উচ্চ অবস্থা। একপাল ছেলেমেয়েছেলেকে কোলে নিয়ে হয়তো আদর করচে–অমনি সমাধিস্থ হয়ে পড়ে। সেদিন আমার কাছে সূক্ষ্মদেহে এসেছিল। সেও প্রেমভক্তি চায়–তাকেও নিয়ে যাবো।
–কি করে বিনা দীক্ষায় এমন উচ্চ অবস্থা পেলে সংসারে থেকে?
–পূৰ্ব্বজন্মের অবস্থা ভাল ছিল। কর্মবন্ধনে আটকে পড়ে এ জন্মে সংসার করতে হয়েছে। সামান্য কর্ম ছিল, এ জন্মে শেষ হয়ে যাবে। তার বাড়ী এই জঙ্গলের বাইরে এক লোকালয়ে। আহীর জাতের। মেয়ে। ওর অবস্থা দেখে আমি পৰ্য্যন্ত অবাক হয়ে গেছি। আমার কাছে এসে কত কাঁদে।
পুষ্প বিদায় নিয়ে চলে এল। মানুষেই দেবতা হয়ে গিয়েচে এ যে। সে কত প্রত্যক্ষ করলে এই জগতে এসে! যে মূল বাসনা আসক্তি ত্যাগ করে শুদ্ধ মুক্ত হয়েছে–সে-ই দেবত্ব প্রাপ্ত হয়েছে, ভগবান তাকেই কৃপা করেচেন। দৃষ্টি উদার ও স্বচ্ছ না হলে কেউই উচ্চ অবস্থা প্রাপ্ত হয় না, অথচ মানুষকে দেবত্বে নিয়ে যাবার জন্যে ঊর্ধ্বলোকে কত ব্যবস্থা, কত আগ্রহ। তবুও কেন অন্ধত্ব ঘোচে না মানুষের, কেন রামলালের মত আশা-বৌদিদির মত জীবেরা ভুবর্লোকের অতি স্কুল আসক্তির বন্ধনে দেবত্বের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত আছে।
বুড়োশিবতলার ঘাটে যতীন এক চুপ করে বসেছিল। পুষ্পকে দেখে খুব খুশি হোল। বল্লে–যত দেখছি, আমিও অবাক হয়ে যাচ্চি, পুষ্প। আমার চোখ খুলে যাচ্চে। তুই কিছু ভাবিসনে, পৃথিবীতে জন্ম নেবো কত বছরের জন্যে? ষাট সত্তর কি আশি? অনন্ত জীবনের তুলনায় ক’দিন? কিসের জন্য মৃত্যু? সব ছায়া, মায়া–একমাত্র আমি অমর, অনন্ত, শাশ্বত। আমাকে কেউ কোনদিন ধ্বংস করতে পারবে না। আজকাল তোর সংসর্গে থেকে আমার চোখ খুলে গিয়েছে।
পুষ্প ওকে রামলালের কথা বল্লে। যতীন সব শুনে হাসতে লাগলো। আজকাল এই শ্রেণীর লোকের জন্যে তার গভীর অনুকম্পা জাগে। পথ দেখিয়ে দেবার কেউ নেই তাই এমনি হয়েছে–ওদের দোষ নেই।
পুষ্প বল্লে–তুমি ওর জন্যে কিছু করো। আমি সেখানে যাবো না, গেলেও তার উপকার হবে না। এক মোহ থেকে আর এক মোহে পড়ে যাবে–
–তোর সাহায্য ছাড়া হবে না পুষ্প, আমি অবিশ্যি গিয়ে দেখছি।
যতীন রামলালকে খুঁজে বার করলে। সে একটি নীচজাতীয়া মেয়ের বাড়ীর উঠানে বসে ছিল। মেয়েটি উেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান ভানচে। তার বয়স ত্রিশ-বত্রিশের কম নয়, কালো ও অত্যন্ত কৃশকায়। সম্ভবত মাঝে মাঝে ম্যালেরিয়াতে ভোগে। মুখোনা নিতান্ত মন্দ নয়, চোখ দুটো বড় বড়–সমস্ত দেহের মধ্যে চোখ দুটোই ভালো।
রামলাল যতীনকে দেখে বল্লে–যতীনদা যে! তোমাকে কে সন্ধান দিলে হে? বুড়োটা নিশ্চয়ই। বেঁচে থাকতে জ্বালিয়েচে আবার মরেও যে একটু ফুর্তি করবো তার যো নেই। হাড় ভাজা ভাজা করলে। সেদিন এসেছিল, আমি হাঁকিয়ে দিয়েচি। বল্লাম–আমি যা ইচ্ছে করবো, তোমার বিষয়ের ভাগ তো পিত্যেশ করিনি যে তোমায় ভয় করবো। এখন আমি স্বাধীন।
যতীন হেসে বল্লে–বুড়োর দোষ নেই। সে তোমার ভালোর জন্যেই সন্ধান দিয়েছে। এই ভাবে বাঁশগাছে তেঁতুলগাছে কতদিন কাটাবে?
–দিব্যি আছি। দোহাই তোমার, তুমি আর লেকচার ঝেড়ো না।
–কিন্তু এতে তোমার লাভটা কি? কেন এর পেছনে পেছনে ঘুরচো–
–আমার দেখেই সুখ। ওর নাম সোনামণি। সোনামণি ধান ভানে, আমি ঐ খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি; আমতলার পুকুরঘাটে নাইতে যায় একা একা–আমি সঙ্গে যাই, যতক্ষণ না নাওয়া হয়, আমি নোনাগাছে বসে বসে দেখি। রাত্রে ও রাঁধে-আমি রান্নাঘরের কোণে চুপ করে বসে থাকি। বেশ চমৎকার দেখতে সোনা, অমন। চেহারা ভদ্দরলোকের ঘরে হয় না। শরীরের বাঁধুনি কি!.আমি তো কোনো অনিষ্ট করচিনে কারো, বসে থাকি এই মাত্র।
–নিজের অনিষ্ট নিজেই করচো। ওপরে উঠতে পারবে না। পৃথিবীর বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে।
–থাকি থাকবো। বেশ ফুৰ্ত্তিতেই আছি–আমি ওপরে উঠতে চাইনে, নীচেও নামতে চাইনে। স্বগে টগুগে তোমরা থাকো গিয়ে। আর ওই বুড়োটা যে দোকানের গদিতে বসে আছে দিনরাত, তাতে বুঝি দোষ হয় না? ওটাকে পারো তো তোমাদের স্বগে নিয়ে যাও টেনে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে যাও এখানে, বেশ আছি। কেন আর জ্বালাও দাদা, বেঁচে থেকে এমন আনন্দে থাকিনি। বেঁচে থাকতে এমন করলে আমায় ওর স্বামী লাঠি নিয়ে তাড়া করতো–এ বেশ আছি, কেউ টের পায় না।
–চলো আমার সঙ্গে একজায়গায়, তোমায় নিয়ে যাবো
–আমায় মাপ করো ভাই। সোনামণিকে ফেলে আমি পাদমেকং ন। গচ্ছতি–
–থাক আর দেবভাষাকে ধ্বংস করে লাভ নেই। এখন আমার সঙ্গে চলো–যাবে?
রামলাল যতীনের ইঙ্গিতে সোনা বাগদিনীর বাড়ীর উঠোন থেকে অল্পদূরে একটা বাঁশঝাড়ের তলায় গিয়ে দাঁড়ালো। কতদিন পরে শীতের দিনে ঝরা শুকনো বাঁশপাতার ধুলোভরা গন্ধ আজ যতীনের নাকে এসে লাগচে। যেন সে দেহেই বেঁচে আছে–পৃথিবী মায়ের বুকের দুলাল। বনমূলোর গাছ কুচি কুচি সাদা ফুলে ভর্তি–দুচারটে বাঁশঝাড়ের পরেই দিগন্তব্যাপী ধানের ক্ষেত, সবে ধান কাটা হয়ে। গিয়েচে অঘ্রাণের শেষে। শুকনো ধানের গোড়া এখনো ক্ষেতের সর্বত্র।
যতীন বোধ হয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, রামলাল অধীর ভাবে বল্লে–কি বলছো বলো যতীনদা।
যতীন বল্লেও কি? আবার ও পাড়ার পুকুরঘাটের দিকে চাইচো কেন? কে আছে এখানে?