–কেউ কিছু বলবে না?
–না, দেবমন্দিরে সবারই অধিকার। যখনই তোমার দেবদর্শনে স্পৃহা জেগেচে, বুঝতে হবে, তখনই তুমি উচ্চতর স্তরের জীব হয়ে। যাবে! ইচ্ছামাত্রেই সিদ্ধি। চলো যমুনার ধরে দাঁড়িয়ে দেখো–
ওরা চীরঘাটের কাছে যমুনার তীরে এসে জ্যোৎস্নালোকে কিছুক্ষণ বসলো। ওদের সঙ্গে সঙ্গে করুণাদেবী ও প্রণয়দেবীও এলেন। কেবলরাম সরল লোক ওর মনে কেমন একধরনের ভক্তির উদয় হোল। যমুনার দিকে চেয়ে ওর দুচোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো। করুণা দেবীকে বল্লে–মা, আমার কি পুণ্য ছিল পূর্বজন্মের? বৃন্দাবন, যমুনার তীর, আপনাদের মত দেবীর দেখা পাওয়া–আজ আমার হোল কি তাই ভাবছি।
করুণাদেবী বল্লেন–কেবলরামকে রেখে এসে পুষ্প, তারপর আমাদের পৌঁছে দেবে–
পুষ্প হেসে বক্রদৃষ্টিতে অদ্ভুতভাবে চেয়ে বল্লে–আমি পৌঁছে দেবো আপনাদের! কেন ঠাট্টা করেন বলুন।
ফেরবার পথে কেবলরাম বল্লে–তোমায় কি যে বলি দিদি। তুমি সাক্ষাৎ দেবী, নইলে এত দয়া! যেখানে নিয়ে গিয়েছিলে, আমার চৌদ্দপুরুষের ভাগ্যি নেই সেখানে যাই। একটা কথা দিদি বলছি। আমার নাতি রামলাল আজ দুবছর হোল এখানে এসেছে পৃথিবী। থেকে। তোমায় বলতে লজ্জা হয়, সম্প্রতি রসুলপুরের এক বাগদী। মাগীর পিছু পিছু ঘুরচে ছ’মাস। সে যদি জল আনতে যায়, ও তার পিছু পিছু যায়; সে যদি রান্নাঘরে রাঁধে, ও তার পাশে বসে থাকে। অন্য সময় সেই মাগীর বাড়ীর উঠোনে এক তেঁতুলগাছে দ্যাখো দিনরাত বসে। কত ধমক দিলাম–কথা শোনে না। একটা উপায় করো তুমি লক্ষ্মীটি। সে মাগী ওকে দেখতে পায় না, ওর ঘরেই সুখ। এ কি বন্ধন বলে দিকি দিদি? ওই তো নরক। তুমি দেবী, ওকে তুমি বাঁচাও এ নরক থেকে।
গভীর রাত্রিকাল। পুষ্প এক সন্ন্যাসিনীর আশ্রমে দেখা করতে গেল। ওকে দেখা পৰ্য্যন্ত কি এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করচে ওঁর প্রতি! না দেখা করে যেন ও থাকতে পারছে না। সন্ন্যাসিনী ওকে দেখে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করলেন। বল্লেন–আপনি সেদিন এসেছিলেন না?
–হ্যাঁ, মা। আপনার দর্শনে পুণ্য, তাই দেখতে এলাম।
সন্ন্যাসিনীর প্রজ্ঞানেত্র উদ্ভাসিত, সুতরাং পুষ্পকে স্থল আবরণে। নিজ দেহকে আবৃত করতে হয়নি। সন্ন্যাসিনী বল্লেন–আপনি বিদেহী, পৃথিবীর ফলমূল নিয়ে অতিথিসৎকার করতে পারলাম না। ত্রুটি মাজ্জনা করবেন।
পুষ্প লজ্জিত হয়ে বল্লে–ওকথা বলে আমায় অপরাধী করবেন না। মা। আমি কত ক্ষুদ্র।
সন্ন্যাসিনী হেসে বল্লেন–আপনি ক্ষুদ্র কে বল্লে–আপনি এখানে। আসবেন আমি সমাধিতে জেনেছি। আপনি আমার প্রেমভক্তি শিক্ষার উপায় করবেন।
পুষ্প সবিস্ময়ে বল্লে–আমি!
–বিশ্বের ভগবান কাকে দিয়ে কি কাজ করান, তা তো বলা যায়। না।
–মা, আপনার বাড়ী কোথায় ছিল? পিতামাতা কে ছিলেন? জানবার বড় কৌতূহল হচ্চে।
–আমার দেশ ছিল পাঞ্জাবে। অল্পবয়সে আমি দীক্ষা নিই, বিবাহ হয়নি, চিরকুমারী। নানাস্থানে ঘুরে অযোধ্যায় আসি। সেখানে সে সময়ে মাঠের মধ্যে গাছের তলায় এক সিদ্ধ মহাপুরষ বাস করতেন– সকলে তাঁকে পাগলা বাবা বলতো। পাগলের মত থাকতেন। তিনি আমায় দয়া করে যোগদীক্ষা দেন। যে সন্ন্যাসীর সঙ্গে সেদিন আপনারা এসেছিলেন, ওঁরও গুরু তিনি।
–তিনি আছেন কোথায় এখন?
-প্রায় পঞ্চাশ ষাট বছর হোল তিনি দেহ রেখেছেন। তিনি যে কত কালের লোক কেউ জানতো না। আমি কখনো সে প্রশ্ন করিনি। এখন বিদেহী অবস্থায় ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়েছেন। জীবন্মুক্ত মহাপুরুষ ছিলেন। মাঝে মাঝে এখনও দেখা দেন। তিনিই বলেছিলেন, তুমি নারী, তোমাকে প্রেমভক্তি শিখতে হবে। অদ্বৈতভূমি থেকে নেমে তোমাকে লীলারস আস্বাদ করতে হবে। তাই অপেক্ষায় আছি। আপনি যে আসবেন তাও তিনি বলেছিলেন।
পুষ্পের চোখ বেয়ে দর দর ধারে জল পড়লো। মনে মনে ভাবলে– ভগবানের কি খেলা! আমার মত নিতান্ত দীনহীনা, অতি সামান্য মেয়েমানুষের ওপর তাঁর কি অসীম অনুগ্রহ। এ কি অদ্ভুত কাণ্ড, কখনো তো এমনি ভাবিনি।
ও বল্লে–আপনার কাছে সেই ঠাকুরেরা আর এসেছিলেন?
–হ্যাঁ দেখুন, ওই এক কাণ্ড। কেন আমার কাছে? মৃন্ময়ী বলে এক দেবী সেদিন এসেছিলেন, কোন্ গ্রামে ভাঙা মন্দিরে থাকেন–কতক্ষণ গল্প করে গেলেন। তাঁর সাধ নতুন মন্দিরে কেউ প্রতিষ্ঠিত করে। আমি বল্লাম, কোনো ধনী গৃহস্থকে স্বপ্ন দিন। আমার কি হাত? আমি কি করতে পারি?
–ওদের কি আপনি এমনি স্থূলচক্ষে দেখেন?
–না, সমাধি অবস্থায় দেখা দেন। আমি বলি, আমি তোমাদের মানি না, চলে যাও। ততই আমার কাছে ভিড়। দেখুন তো মুশকিল!
–এও ভগবানের কৌশল আপনাকে প্রেমভক্তি শিক্ষা দেওয়ার। নীরস অদ্বৈতজ্ঞানী মনকে সরস করবার আয়োজন।
–আমি ওসব মানি না।
–তবে প্রেমভক্তি কি করে লাভ হবে?
–সাকার উপাসনা মায়িক। যে মৃন্ময়ী দেবীর পূজা করবে, সে দেবীকে নিয়েই মশগুল থাকবে; যে শ্যামসুন্দরের পূজা করবে, সে তাঁর দর্শন পেয়েই খুশি থাকবে। ও সব এক প্রকারের বন্ধন। ওতে বন্ধ হয়ে থাকলে আরও উচ্চভূমিতে উঠে ব্ৰহ্মদর্শন তার হবে না, নিজের আত্মাকে ব্রহ্মে সে লীন করতেও পারবে না। মায়া তাকে আবদ্ধ করবে।
-আপনি যা জানেন, আমি তা জানিনে দেবী। তবে আমি এইটুকু জানি প্রকৃত ভক্ত যে, সে মুক্তি চায় না, ব্রহ্মত্ব চায় না। ভগবানের দাস হয়ে থাকতে চায়, রস আস্বাদ করতে চায়। ভক্তির পথেই সে সমাধিলাভ করে, ব্ৰহ্মদর্শনও তার হয়। তবে এসব আমার শোনা কথা–আমি অজ্ঞান, কি জানি বলুন। আমার সঙ্গে বৃন্দাবনে চলুন, গোবিন্দ-মন্দিরে আরতির সময় কত ভক্তের দর্শন পাবেন। তাঁরা সব বলে দেবেন।