আচ্ছা, আশা-বৌদিকে আনলে হয় না? ধন্য হয়ে যায়, উদ্ধার হয়ে যায় একদিনে সে।
করুণাদেবীকে সে কথাটা জিজ্ঞেস করলে। দেবী বল্লেন–আশার আধ্যাত্মিক বুদ্ধি এখনও সুপ্ত। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে, দেখেও দেখবে না এ সব। অত সহজে পাপী উদ্ধার হয় না পুষ্প, তাহোলে আমরা বসে থাকতাম না-নরক উজাড় করে পাপী হাজারে হাজারে নিয়ে এসে ফেলতাম।
পুষ্প লজ্জিত হোল। প্রণয়দেবী বল্লেন–তোমাদের তিনজনের ওপর আমার দৃষ্টি বহু জন্ম আগে থেকে রেখেচি। এখনও অনেক গতাগতি বাকি ওদের দুজনের। পুনর্জন্ম ভিন্ন আশার আত্মা কিছুতেই কৰ্ম্মক্ষয় করতে পারবে না। তুমি ব্যস্ত হয়ো না পুষ্প, যা করবার তিনিই করবেন। আমরা তাঁর দাসী মাত্র।
পুষ্প ওঁদের অনুমতি নিয়ে চক্ষের নিমিষে কেবলরামের স্তরে এসে দেখলে, বৃদ্ধ সেখানে নেই। তবে বোধহয় আবার কুড়লে-বিনোদপুরে ওর ছেলেদের আড়তে গিয়ে বসেচে। কিন্তু একা যেতে পুষ্পের বড় ভয় করে। পৃথিবীর স্থূলস্তরে নিম্নশ্রেণীর দুষ্ট আত্মাদের উপদ্রব বড় বেশি, এরা অনেক সময় দেহধারী ও বিদেহী সকলকেই বিপদে ফেলবার চেষ্টা করে। বৃন্দাবনে ছিল এতক্ষণ, পৃথিবীর হোলেও সে একটা পবিত্র দেবস্থান, ওখানে প্রেতযোনির উপদ্রব খুব কম।
ভগবানের নাম স্মরণ করে সে কুড়লে-বিনোদপুরে কুণ্ডুদের গদিতে এসে দেখে বৃদ্ধ কেবলরাম তার বড় ছেলে বিনোদের পাশে হাতবাক্স সামনে বসে আছে। সন্ধ্যার সময়, হাটুরে খরিদদারের ভিড় দোকানে। বিনোদের দুই কর্মচারী হেঁকে বলেচে–দুজোড়া ফুলন শাড়ী, ছনং–
বিনোদ খাতায় টুকতে ঢুকতে মাথা তুলে বলচে–টাকা না লোট?
খরিদ্দার বলচে–আজ্ঞে লোট কুণ্ডু মশায়। দু’মণ পাট ব্যাচলাম রাম। তেলির আড়তে–সব লোট দেলে। লোট এখন ক’নে ভাঙাতি যাই আপনাদের দোকান ছাড়া? বাবু, কিছু কম নেন্ দামটা।
বিনোদের কিছু বলবার পূর্বেই তার পার্শ্বোপবিষ্ট কেবলরাম বলে। উঠলো–ওতে লাভ নেই এক পয়সাও! তুমি পুরোনো খদ্দের বলে শুধু কেনা-দামে দেওয়া।
পুষ্প বুঝতে পারলে, এ অতি কপটকথা। বৃদ্ধের মন বলচে জোড়াপিছু দেড় টাকা লাভ হয়েছে এই পাড়াগাঁয়ে মূর্খ খদ্দেরের কাছে। এই সময় বিনোদ বল্লে–যাও, দু’আনা কম দাওগে জোড়ায়, তুমি পুরোনো খদ্দের, তোমার সঙ্গে অন্যরকম।
কেবলরাম পুত্রের ওপর চটে উঠে বল্লে–তবেই তুমি ব্যবসা করেচ! খদ্দেরের এককথায় অমনি জোড়ায় দু’ আনা ছাড়!
অবিশ্যি ওর কথা দোকানদার বা খরিদ্দার কেউ শুনতে পেল না! পুষ্প ওর পাশে গিয়ে ডাকলে–ও দাদু। পুষ্পের কণ্ঠস্বর শুনে বৃদ্ধ চমকে উঠে ওর দিকে চাইলে। পুষ্প হাসিমুখে বল্লে–আচ্ছা, কেন এই সন্দেবেলা বসে-বসে মিথ্যে কথাগুলো বেমালুম কইচ দাদু? ছিঃ–
কেবলরাম অপরাধীর ন্যায় উঠে দাঁড়ালো। পুষ্প বল্লে–আবার তুমি এই দোকানে এসে বসে আছ। পৃথিবীর আসক্তি তোমার গেল না? কি হবে তোমার দোকানপসার আর খদ্দেরে? টাকার লাভলোকসানেই বা তোমার কি হবে?
কেবলরাম বিষণ্ণভাবে বল্লে–যাই কোথায় দিদি বলো? এই গদি আর আড়ত ছাড়া গত পঞ্চাশ বছর আর কিছু চিনিনি। কোথাও ভাল। লাগে না। এখানটাতে এলে পুরোনো অভ্যেসের বশে আড়তের কাজ করে যাই। নইলে কি করি বলো? তুমিই তো দিদি দর্শন দাওনি কতদিন।
–আচ্ছা এখুনি চলো আমার সঙ্গে..দেরি করো না, বেরিয়ে এসো।
মুহূর্তের মধ্যে কেবলরামকে নিয়ে পুষ্প গোপাল-মন্দিরে এল। ধূপধূনার সুগন্ধি ধূমে মন্দিরের গর্ভগৃহ ভরে গিয়েছে, আরতি তখনও পূৰ্ব্ববৎ চলচে-পাঁচমিনিটের জন্য মাত্র পুষ্প অনুপস্থিত ছিল। কেবলরাম পুষ্পের কৃপায় সজ্ঞান অবস্থায় আছে, জ্যোতির্ময়। মহাপুরুষদের সে দেখে ভয়ে সম্ভ্রমে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে। সন্ন্যাসীর তেজঃপুঞ্জ দেহকান্তির দিকে আড়ে আড়ে চেয়ে দেখলে। আরতির শেষে যখন সবাই মন্দির-দ্বারপথে বেরিয়ে আসছে, তখন একজন বিদেহী ভক্ত ক্ষেমদাসকে জিজ্ঞেস্ করলে–প্রভু, শুনেচি বৃন্দাবনে যমুনাতীরে জ্যোৎস্নারাত্রে শ্রীকৃষ্ণের নিত্যলীলা হয়–আমি কি দেখতে পাবো? আমি এখানে নতুন এসেচি।
ক্ষেমদাস বল্লেন–আপনি গিয়ে দেখতে পারেন। লোকে দেখে অনেকে, ভাগ্যবান ভক্ত হওয়া চাই।
কেবলরাম অবাক হয়ে পুষ্পকে বল্লে–এটা কোন্ জায়গা দিদি?
ক্ষেমদাস বল্লেন–তুমি চিনতে পারলে না? এটা বৃন্দাবন, গোপাল মন্দির।
পুষ্প বল্লে–আর ইনি বৈষ্ণব কবি ক্ষেমদাস–
কেবলরাম থতমত খেয়ে ক্ষেমদাসের পায়ে সাষ্টাঙ্গ হয়ে প্রণাম করলে। তারপর করুণাদেবীর সামনে ওকে এনে ফেলতেই ও আরও আড়ষ্ট ও কাঁচুমাচু হয়ে গেল। করুণাদেবী রহস্য করে বল্লেন–তোমার নানীর দৌলতে স্বর্গ পাবে তুমি।
কেবলরামের চোখ ধাঁধিয়ে গেল এই দুই দেবীর অপরূপ রূপের জ্যোতিতে। সে হাতজোড় করে বল্লে–স্বর্গ তো এখানে। আমার মত পাপী যে বৃন্দাবনে এসে আরতি দেখেচে আপনাদের মত দেবী, এঁদের মত মহাপুরুষের দেখা পেয়েছে–আর তো কিছু বাকি নেই স্বর্গের।
পুষ্প ধমক দিয়ে বল্লে–এখন ছেড়ে দিলে আবার কুড়লে বিনোদপুরের দোকানে গিয়ে বসবে তো? আর মিথ্যে কথা বলবে।
কেবলরাম জিভ কেটে বল্লে–আর না।
–ঠিক?
–হঠাৎ ছাড়তে পারবো না মিথ্যে কথা বলে কি হবে। কোথায়। যাই বলো তো সন্দেবেলাটা।
–কেন, এই গোপাল-মন্দিরে এসে আরতি দেখবে রোজ। কবি ক্ষেমদাস রোজ এখানে এ-সময় থাকেন, তোমায় যত্ন করবেন দাদু।