–আপাতত আমার একটি গুরুভগ্নী প্রেমভক্তির জন্যে ব্যাকুলা। তাকে দিন দয়া করে।
–কোথায়?
–সম্প্রতি দেহে বৰ্তমান আছেন, মহানদীর তীরের বনমধ্যে তাঁর আসন। পরমাত্মার দর্শন পেয়ে ধন্য হয়েচেন। বহুঁকাল থেকে দেহধারিণী। আপনি আহ্বান করলে তিনি এখানেই আসবেন।
–আমি অকিঞ্চন। আমার কি সাধ্য প্রেমভক্তি দিই। গোপাল দেবেন–
পুষ্প এই সময়েই হঠাৎ জানু পেতে বসে করজোড়ে বিনীত কণ্ঠে বল্লে–ওই সঙ্গে আমাকেও দিন আচাৰ্য্যদেব। আমার একমাত্র অবলম্বন।
ক্ষেমদাস উৎসাহে হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন–সাধু! সাধু!
রঘুনাথ পুষ্পের মাথায় হাত দিয়ে বল্লেন–আমি কে মা? গোপালের কাছে চাও। আমি আশীৰ্বাদ করি তুমি পাবে।
পুষ্প যতীনকে দেখিয়ে বল্লে–এঁকে আশীর্বাদ করুন। ইনি শীঘ্র পুনর্জন্ম গ্রহণ করবেন। আদেশ হয়ে গেছে।
রঘুনাথ যতীনের দিকে ভাল করে চেয়ে বল্লেন–পুনর্জন্ম হচ্চে? খুব ভাল। ভগবানে মন যেন থাকে আশীর্বাদ করচি। পুনর্জন্মে ভয় কি, যদি কৃষ্ণপদে মতি থাকে।
যতীন পুষ্প ভিন্ন উপস্থিত সকলের পাদস্পর্শ করে প্রণাম করলে।
পুষ্প বল্লে–প্রভু, আবার আপনাদের দেখা ইনি পাবেন?
সন্ন্যাসী বল্লেন–নিশ্চয়, দেহ অন্তে। আমরা আর কোথায় যাচ্চি।
রঘুনাথ বল্লে–ইচ্ছা করে প্রভু, আর একবার পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে ভক্তিধৰ্ম্ম প্রচার করে আসি। জীবের বড় কষ্ট। দেখে শুনে বড় কষ্ট পাই। জীবের মঙ্গলের জন্য প্রয়োজন বুঝলে একবার ছেড়ে শতবার যেতে প্রস্তুত আছি। সেদিন মহাপ্রভুকে বলেছিলাম, উনি বল্লেন–এখন পৃথিবীতে অন্য সময় এসেছে, লোকজনের অন্যপ্রকার মতি। এখন আমাদের পূর্ধ্বতন পন্থায় কাজ হবে না। গ্রহদেব বৈশ্রবণ এ বিষয়ে সেদিন মহাপ্রভু ও আরও ঊর্ধ্বলোকের কয়েকটি মহাপুরুষের সঙ্গে পরামর্শ করেচেন! তাঁরা বলেন, পৃথিবী এখনও তৈরী হয়নি। গ্রহদেব বৈশ্রবণ কয়েকজন শক্তিমান আত্মা পাঠাচ্ছেন পৃথিবীতে, এরা ধ্বংস ও দুর্দৈব আনবেন পৃথিবীতে গিয়ে। পৃথিবী আলোড়িত হবে–লোকের দৃষ্টি ঊর্ধ্বমুখী হবে। ভোগবাদ ও জড়বাদের অবসান না হোলে জীবের মঙ্গল নেই। ঢেলে সাজাতে হবে গোটা পৃথিবীটাকে। আপনিই তো ইচ্ছা করলে করতে পারেন।
সন্ন্যাসী মৃদু হেসে চুপ করে রইলেন।
যতীন অসর্তক মুহূর্তে সবিস্ময়ে বলে উঠল–কে? ইনি!
ক্ষেমদাস বল্লেন-হাঁ, ইনি। অসাধারণ শক্তিশালী পুরুষ, ওঁরা গ্রহদেবের সমান। ইচ্ছামাত্র সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় ঘটাতে পারেন। ব্রহ্মসূত্রে বলেচে-সংকল্পাদেব তৎশ্রুতেঃ। মুক্তপুরুষের সমস্ত ঐশ্বৰ্য্য সংকল্পমাত্র উদয় হয়।
সন্ন্যাসী হেসে বল্লেন–ঝোঁকের মাথায় একটু বেশি বল্লে কবি। ভোগমাত্ৰমেম্ অনাদিসিদ্ধেশ্বরেণ সমান–শঙ্করাচাৰ্য্য কি বলেচেন প্রণিধান কর। মুক্তের ভোগ ঈশ্বরের সমান হয়, শক্তি কি তাঁর সমান। হয়?
–আমি ঈশ্বরের কথা বলিনি, গ্রহদেবের কথা বলেছি।
–গ্রহদেব শক্তিমান বটে কিন্তু ঈশ্বরের বিনা অনুজ্ঞায় তিনি কিছুই। করতে পারেন না।
–সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় করতে সমর্থ কি না?
–হ্যাঁ। কিন্তু ঈশ্বরের অনুমতিক্রমে।
–আপনি?
–না। আমার ওপর সে ভার ন্যস্ত নেই। আমি আদার ব্যাপারী, সৃষ্টি স্থিতির খোঁজে আমার দরকার কি? সৃষ্টি বলচোই বা কাকে? নির্গুণ ব্রহ্ম যখন দেশ ও কালের সীমার মধ্যে নিজেকে প্রসারিত করেন, তখন তাকে বলে সৃষ্টি–ঊর্ণনাভ যেমন নিজের দেহনিঃসৃত রস তন্তুরূপে প্রসারিত করে।
রঘুনাথদাস বল্লেন–মহাপুরুষ, ক্ষেমদাস ঠিকই বলেছেন। আপনি পারেন সব, অসাধারণ শক্তি আপনাদের। সেই শক্তি নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। কোনো কাজে আসছে না। ভগবানের দাসভাবে ভক্তভাবে তাঁকে সেবা করে সেই শক্তির সদ্ব্যবহার করুন। কিংবা পৃথিবীর বা অন্য গ্রহলোকের জীবকুলের সেবা করুন। জীবের সেবায় স্বয়ং ভগবান তাঁর পার্শ্বচরদের নিয়ে সৰ্ব্বদা নিযুক্ত। আপনি মহাজ্ঞানী, আপনাকে আমি কি উপদেশ দেব?
সন্ন্যাসী বিনীতভাবে নমস্কার করে বল্লেন–আপনার আদেশ শিরোধার্য্য।
যতীন অবাক হয়ে ভাবলে, এত বড় লোক, কিন্তু কি অদ্ভুত বিনয়। এদের। সত্যি, বড় ভাল লাগচে।
ক্ষেমদাস হঠাৎ বলে উঠলেন–বৃন্দাবনে আরতি হচ্চে গোপাল মন্দিরে। আমি আর থাকতে পারবো না। চল।
আজও পৃথিবীতে সুন্দর জ্যোৎস্না। বৃন্দাবনের বনপথে আলোছায়ার খেলা দেখে ওরা সবাই মুগ্ধ। শহরে ইলেকট্রিক আলো জ্বলচে, মোটর যাচ্চে ধুলো উড়িয়ে, লোক গিজগিজ করছে। চানাচুরওয়ালা সুর করে মোড়ে দাঁড়িয়ে সওদা ফিরি করচে। গোপালের মন্দিরের আরতির সময়ে কত অশরীরী ভক্ত, কত জ্যোতির্ময় আত্মা সেদিনকার মত মন্দিরের মধ্যে উপস্থিত। অনেকে স্বর্গীয় পুষ্প বিগ্রহের অঙ্গে বর্ষণ করতে লাগলেন আরতির সময়ে।
পুষ্প চেয়ে দেখতে দেখতে এঁদের মধ্যে করুণাদেবীকে দেখে চমকে উঠলো। আরও একটি দেবী আছেন ওঁর সঙ্গে। দুজনে মন্দিরের এক কোণে সাধারণ গৃহস্থঘরের নারীদের মত শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আরতি দর্শন করছেন। পুষ্পকে তাঁরা ডাকতেই সে কাছে গেল। পুষ্প দেখলে, অপরা দেবীটি তারই পুৰ্ব্বপরিচিতা প্রণয়দেবী।
প্রণয়দেবী বল্লেন–অনেকদিন তোমায় দেখিনি। আরতি শেষ হয়ে যাক, বাইরে চলো, কথা আছে।
সঙ্গে সঙ্গে পুষ্পের মনে পড়লো কেবলরাম কুণ্ডুর কথা। প্রণয়দেবীর ‘অনেকদিন দেখিনি’ এই কথাতে ওর মনে পড়লো। সেই নিম্নস্তরের বিষয়াসক্ত আত্মাকে সে দাদু বলে ডেকেচে। অথচ অনেকদিন তার কাছে যাওয়া হয়নি বটে। তাকে আজ এখুনি বৃন্দাবনে এনে। গোপালমন্দিরে আরতি দেখাতে হবে। ধন্য হয়ে যাবে কেবলরাম– স্বর্গ-মর্ত্যের মিলনদৃশ্য এভাবে দেখার সৌভাগ্য আর তার হবে না।