সন্ন্যাসী বল্লেন–আচ্ছা, এখন বন্ধ করো। তুমি আমাকে বলচো নীরস। তোমাকে আমি এমন এক জ্ঞানীর কাছে নিয়ে যাবো যিনি সম্পূর্ণ নাস্তিক, জড়বাদী। পঞ্চভূতের বিকারে এই বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে বলেন। ঈশ্বর মানেন না, সৃষ্টিকর্তা মানেন না; আত্মাকে বলেন পঞ্চভূতের বিকার, জড়ের ধৰ্ম্মে আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়েছে, আপনা-আপনিই একদিন লয় হবে–এই মত পোষণ করেন।
–কে? লোকায়ত দর্শনের কর্তা চার্বাক?
–চাৰ্ব্বাক নন, তাঁর প্রভাবান্বিত কোনো শিষ্য?
–কি অবস্থা লাভ করছেন?
–স্থাণুবং অচলাবস্থা। খুব উচ্চস্তরেই আছেন, পুরুষকারের বলে উন্নতভূমি লাভ করেচেন, কিন্তু মুক্তি হয়নি। এর মধ্যে দুবার পৃথিবী ঘুরে এসেছেন। বলেন, এও জড়ের ধৰ্ম্ম! মুক্তি বলে নেই। ঈশ্বর মিথ্যা। কাকে তিনি উপসনা করবেন? পুনর্জন্মে দুঃখিত নন। জন্মান্তরীণ স্মৃতি জ্বলজ্বল করচে মনে।
-কি অবলম্বনে আছেন?
–জড়ের ধর্ম পরীক্ষা করেন। তরুণ শিষ্যদের মধ্যে প্রচার করেন। পৃথিবীতে বহু তরুণদলকে যুগে যুগে প্রভাবান্বিত করচেন জড়ধৰ্ম্মের প্রতিপাদনের জন্য। ব্যাসক্তি শূন্য, উদার পুরুষ।
-মৃত্যুর পরে দেহধ্বংসে আত্মা থাকে দেখেও জড়বাদী?
–হাঁ। বলেন, ওটাও জড়ের ধর্ম। গুটিপোকা দেহত্যাগ করে। প্রজাপতি হচ্চে এও তো দেখা যায়। আবশ্যক কি ঈশ্বরকে টেনে আনবার?
ক্ষেমদাস কানে আঙুল দিয়ে বল্লেন–ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু, শুনতে নেই এসব কথা।
–কেন শুনতে নেই? এই দ্যাখো তোমাদের অনুদারত্ব। আমরা বলি, ব্রহ্মই জগতের সব হয়ে আছেন। নাস্তিক যিনি তিনি ব্রহ্মের বাইরে নন। ব্রহ্মের মধ্যে থেকে তিনি একথা বলছেন। এমন একদিন আসবে, ব্ৰহ্মজ্ঞান তিনি লাভ করবেন। বাদ পড়বেন না।
সন্ন্যাসিনী বল্লেন–আমারও তাই মত।
ক্ষেমদাস অধীরভাবে বল্লেন–বেশ, বেশ। ওসব আলোচনা এখন। থাক। চলে যাওয়া যাক। রাত্রি প্রভাত হয়ে এল–জ্যোৎস্না ম্লান হয়ে আসচে। ওই শোনো ময়ূর ডাকচে বনে।
সন্ন্যাসিনীকে পুনরায় বন্দনা করে সকলে সেই গভীর বন পরিত্যাগ করলেন। কুটীরের আশেপাশে অনেক বন্য দেবকাঞ্চন ফুল ফুটে আছে ম্লান জ্যোৎস্নালোকে। আদরের শৈলচূড়া শেষরাত্রের হিমবাষ্পে অস্পষ্ট দেখাচ্চে। বন্য কুকুটের রব রজনীর শেষ যাম ঘোষণা করচে।
ক্ষেমদাস আকাশপথে বল্লেন–কি সন্ন্যাসী, যাবে তো রঘুনাথদাসের আশ্রমে?
সন্ন্যাসী রাজী হওয়াতে ওরা চক্ষের নিমেষে বৈষ্ণবাচার্য্যের আশ্রমের সামনে এসে পড়লো। ওরা সকলে রঘুনাথদাসের আসনের দিকে গেল– পুষ্প গেল গোপাল-বিগ্রহ দেখতে ও তার প্রাণের ব্যথা গোপালের পায়ে নিবেদন করতে। নীল স্ফটিকের অপূৰ্ব বিগ্রহের মুখে যেন করুণার। হাসি লেগেই আছে। পুষ্প বাইরে এসে দাঁড়ালো, ঐ বিরাট অনন্ত বিশ্ব, আকাশের পটে কোটি কোটি নক্ষত্ররাজি (বৈষ্ণবাচাৰ্য্য আশ্রমে এখন রজনীর প্রথম যাম)–সেই যে সেদিন মহাপুরুষ উপনিষদের বাক্য উচ্চারণ করে শুনিয়েছিলেন–অস্য ব্রহ্মাণ্ডস্য সমন্ততঃ স্থিতানি এতাদৃ শান্যনন্তকোর্টিব্রহ্মাণ্ডানি সাবরণানি জ্বলন্তি–এই ব্রহ্মাণ্ডের আশেপাশে আরও অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ড জ্বলচে-সব ব্রহ্মাণ্ডের যিনি অধীশ্বর, সেই বিরাট দেবতা কেন এখানে ক্ষুদ্র বিগ্রহে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন কিসের টানে কে বলবে?
পুষ্প প্রণাম করলে সাষ্টাঙ্গে। সে বিরাটের কতটুকু ধারণা করতে পারে, মেয়েমানুষ সে। সে অতি ক্ষুদ্র নারী মাত্র। দয়া করে মধুরূপে ধরা না দিলে সে ক্ষীরোদসাগরশায়ী মহাবিষ্ণুর কিংবা তাঁর চেয়েও এককাটি সরেশ নিরাকার পরব্রহ্মের কি ধারণা করতে সমর্থ? মন্দির প্রনাম করে উঠে ব্যাকুল কণ্ঠে প্রার্থনা করলে–হে ঠাকুর, আশা বৌদিদিকে কৃপা কর। এবার যতীনদা ও আশার জন্ম তোমার আশীর্বাদে যেন সার্থক হয়ে অঠে। আর যেন আশার কুপথে মতি না হয় হে ঠাকুর। ওর প্রারব্ধ কৰ্ম্ম এবার যেন ক্ষয় হয়। ওকে দয়া কর।
মন্দিরের নিভৃত কুঞ্জতলে অপূৰ্ব্ব পুস্পবাস। যেন বহু জাতী, যূথী, মালতী, হেনা নাগকেশর একসঙ্গে প্রস্ফুটিত হয়েছে। সন্ন্যাসী ও ক্ষেমদাস শ্বেতপ্রস্তরের চত্বরে বৃক্ষতলে বসে রঘুনাথদাসের সঙ্গে আলোচনা করচেন।
রঘুনাথদাস বলছেন–আপনি আমার বিগ্রহটি দর্শন করে আসুন। আপনার ভক্তি হবে। উনি ভক্তি আকর্ষণ করেন। আপনার আগমনে। আমার আশ্রম আজ ধন্য হয়ে গেল। কিছুকাল এখানে থাকুন।
সন্ন্যাসী বল্লেন–আপনি মহাপুরুষ, আপনার নিকটে থাকবো এ তো পরম সৌভাগ্য। তবে এবার নয়, আমি ঘুরে আসবো। বিগ্রহ দর্শন। করে আসি।
বিগ্রহ দর্শন করে একটু পরেই ফিরলেন। বল্লেন–আপনার বিগ্রহ দেখচি বড় বিপজ্জনক বস্তু–সত্যিই আমাকে উনি আকর্ষণ করছেন। আমায় বল্লেন–আমায় কেমন লাগছে? আমি বল্লাম–আমি তোমাকে মানি না। একরকম জোর করে চলে এসেচি–
বলে আপন মনেই হাসতে লাগলেন।
রঘুনাথদাস বল্লেন–আমার গোপাল আপনার ভক্তি আকর্ষণ করতে চাইচেন। আপনি দেবেন না?
–ক্ষমা করবেন আচার্য্যদেব। আমার সংশয় যেদিন ছিন্ন হবে। সেদিন এসে আপনার আশ্রমে দীক্ষা নেবো প্রেমভক্তির। এখন ওসব আমি পুতুল-পূজোর সমান মনে করি।
রঘুনাথদাসের প্রশান্ত মুখমণ্ডলে মৃদুমন্দ হাসি ফুটলো। ঈষৎ দর্পভরে বল্লেন–আমার গোপালের ক্ষমতা থাকে, আপনাকে তিনি ভজাবেন। পুতুল কি কথা বলে? আপনি ব্রহ্মবিৎ, ভেবে দেখুন। আপনার মত ভক্ত উনি চাইচেন। ব্রহ্মভূমি থেকে নেমে এসে ভগবানের লীলাসঙ্গী হয়ে থাকুন।