সন্ন্যাসিনী হেসে হিন্দীতে বল্লেন–পরমাত্মা যেমন রেখেছেন। এঁরাও তো দেখচি বিদেহী আত্মা। এঁদের এনেচ কেন?
পুষ্প ও যতীন সন্ন্যাসিনীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। ক্ষেমদাস যুক্তকরে নমস্কার করলেন।
সন্ন্যাসী বল্লেন–এরা এসেছেন তোমায় দেখতে। ইনি বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি ক্ষেমদাস–
সন্ন্যাসিনী বল্লেন–আইয়ে মহারাজ, আপকা চরণধূলিসে হামারা আশ্রম পবিত্র হো গিয়া–পরমাত্মাকি কৃপা।
ক্ষেমদাস বল্লেন–মা, আপনি দেবী, আপনার দর্শনে আমরা পুণ্যলাভ করলাম।
সন্ন্যাসিনীর সুন্দর মুখের লাবণ্যময় হাসি অরণ্যভূমির জ্যোৎস্নাস্নাত সৌন্দৰ্য্যকে যেন আরও বাড়িয়ে তুলেচে। কুটীরের দ্বারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বল্লেন–এহি নদীমে আজ পূর্ণিমাকী রাতমে স্বৰ্গসে উতার কর অপ্সরীলোগ্ নতে থে। হাম বহুৎ বরষসে দেখতে হেঁ। আপকো মালুম হ্যাঁয়?
ক্ষেমদাস বল্লেন–না মা, আমরা তো জানি না। আমাদের দেখাবেন?
–আপ দেখনে মাংতা?
–হাঁ মা, দেখালেই দেখি!
সন্ন্যাসী বল্লেন–এর বয়েস কত বল তো যতীন?
যতীন সঙ্কুচিত ভাবে বল্লে–আমি কি বলবো? দেখে তো মনে হয়। কুড়ি-বাইশ।
সন্ন্যাসিনী খিল্ খিল করে হেসে উঠলেন বালিকার মত।
সন্ন্যাসী বল্লেন–তুমি তোমার জ্ঞান-মত বলেচ, তোমার দোষ নেই। তোমার ধারণা নেই এ বিষয়ে।
সন্ন্যাসিনী বল্লেন–তুম ক্যা বোলতা হ্যাঁয় রে বাচ্চা? হামারা তো এহি আসন পর পঁচিশ বরষ বীত গিয়া–ইসকা পলে পঞ্জাবমে রাভি নদীকী তীরমে করিব সত্তর বরষ আসন থা। গুরুজীকা অনুজ্ঞাপর এহি বনমে মহানদীকে কিনারপর আশ্রম বনায়া।
যতীন মনে মনে হিসেব করে বল্লে–তা হোলে আমার প্রপিতামহীর চেয়েও আপনি বড়–
সন্ন্যাসী বল্লেন–ওঁর বয়েস দেড়শো বছরের কাছাকাছি–বরং কিছু। বেশি হবে তো কম, নয়।
ক্ষেমদাস বল্লেন–মা, দেহধারী হয়ে আছেন যে এখনো?
সন্ন্যাসিনী হেসে বল্লেন–বহুং নেতি ধৌত কিয়াইসিসে শরীর বন। গিয়া। আভি ধ্বংস নেহি হোগা কোই পান্ ছ’ শো বরষ। কোই হরজ নেহি, রহে তো রহে।
যতীন আপন মনে ভাবলে–বাবাঃ, এই দুর্গম বনের মধ্যে উনি। একা কি করে থাকেন। বাঘের ভয় করে না? এ তো বাঘের আড্ডা দেখে এলাম।
সন্ন্যাসিনী ওর মন বুঝেই যেন বল্লেন–যখন সমাধিতে থাকি তখন বাঘ আসে, বিষাক্ত সাপ এসে মাথায় ওঠে। গায়ে বেড়ায়। সমাধি ভাঙলে ওদের যাতায়াতের চিহ্ন দেখে বুঝতে পারি।
সন্ন্যাসী বল্লেন–আজকাল কি আহার ছেড়েচ?
–না। কন্দমূল খাই, বেলগাছ আছে আশ্রমের পেছনে অনেক, বেল। খাই। সামান্যই আহার।
ক্ষেমদাস বল্লেন–মা, তুমিও কি প্রেমভক্তির বিপক্ষে? তুমিও নীরস অদ্বৈতবাদী?
সন্ন্যাসিনী হেসে বল্লেন–মাৎ পুছিয়ে। প্রেমভক্তি বহুৎ কৃপাসে লাভ হোতা হ্যাঁয়–হামারা তো তিন যুগ গুজার গিয়া, ও বস্তু নেহি মিলা। কাঁহা মিলেগা বাৎলাইয়ে মহাত্মা কৃপা কর। আপ দিজিয়ে হামকো!
ক্ষেমদাস বল্লেন–আমার শক্তি নেই মা। আমি কবি, এই পৰ্য্যন্ত। ও সব দেওয়া নেওয়ার মধ্যে আমি নেই। তবে তোমাকে আমি ঊর্ধ্বলোকে বৈষ্ণবাচাৰ্য্যদের আশ্রমে নিয়ে যেতে পারি, তাঁদের কাছে উপদেশ পেতে পারো। তবে দরকার কি মা? তোমরা তো প্রতিক্ষণে সমাধি-অবস্থায় ব্রহ্মকে আস্বাদ করচো–কি হবে প্রেমভক্তি?
–আমার কাছে গৃহস্থদের নানা দেবদেবী আসেন, নানা দেশ থেকে আসেন–একা থাকি বলে মাঝে মাঝে সঙ্গ দিতে আসেন। লম্বদামোদর, গোপাল, উগ্রতারা, মৃন্ময়ী, শ্যামরায়, অষ্টভুজা–আরও কত কি নাম। এসে গল্পগুজব করেন, সুখদুঃখের কথা বলেন। সেদিন এক ঠাকুর এসে হাজির আপনাদের বাংলাদেশের মুরশিদাবাদ জেলার কি গ্রাম থেকে–নাম শ্যামসুন্দর। আমায় এসে ছলছল চোখে বল্লেন–যে গ্রামে আছেন, সেখানে নাকি গৃহস্থেরা অনাদর করচে, ঠিকমত ভোগ দিচ্চে না, খেতে পান না–এই সব। তা আমি বল্লাম–আমার কাছে কেন। তুমি? আমি তোমাদের মানিনে। যারা মানে তাদের কাছে গিয়ে প্রকট হও, তোমার নালিশ জানাও, আমাকে বলে কি হবে? বালক বিগ্রহ, ওর চোখে জল দেখে কষ্ট হোল–পাষণ্ডী গৃহস্থেরা কেন সেবা করে না। কি জানি। ওই সব দেখে আমার মন কেমন করে, মনে হয় প্রেমভক্তি হোলে এঁদের নিয়ে আনন্দ করতাম।
সন্ন্যাসী হেসে বলেন–মায়া, মায়া, নির্বিকল্প ভূমি থেকে নেমে এসে তুমি আবার ঐ সব মায়িক ঠাকুরদেবতার সঙ্গে সম্বন্ধ পাতাতে চাও?
ক্ষেমদাস বলেন–মা, তোমাকে প্রেমভক্তি দেবার জন্যই ওই সব দেবদেবী আসেন–আরও আসেন তুমি মেয়েমানুষ বলে–হাজার অদ্বৈতবাদী হোলেও এখন তোমাদের মন, এই এঁদের মত কঠোর, নীরস, শুষ্ক হয়ে ওঠেনি। তাই তোমার কাছে আসেন, কই এঁর কাছে তো আসেন না? এলে আমল পাবেন না বলেই আসেন না। ভগবানও প্রেমভক্তির কাঙাল, যে ভক্ত তারই কাছে লোভীর মত ঘোরেন। যে। প্রেমভক্তি দিতে পারবে না, তার কাছে তো তিনি–
সন্ন্যাসী বাধা দিয়ে বিরক্তির সুরে বলেন–আঃ, তোমার ওই সব অসার, ফাঁকা ভাবুকতাগুলো রাখবে দয়া করে? ওতে আমার গা ঘিন। ঘিন করে সত্যি বলছি। যত খুশি প্রেমভক্তি বিলোও গিয়ে তোমার সেই বৈষ্ণবাচার্য্যের আখড়ায়–আমাদের আর শুনিও না–যত খুশি কাব্যরচনা কর বৃন্দাবন আর চাঁদের আলো আর কদম্বমূল নিয়ে সেখানে বসে।
ক্ষেমদাস বল্লেন–তোমাকেও একদিন ভক্তির ক্ষুরে মাথা মুড়তে হবে হে কঠোর জ্ঞানমার্গী সন্ন্যাসী। আমার নাম যদি ক্ষেমদাস হয়–