–যোগ-প্রক্রিয়ায় দেহ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গিয়েছে, তাই দেহ ধারণ করেই আছেন। বাসনাকামনা-শূন্য মুক্তপুরুষ তিনি, দেহে থাকাও যা, দেহে না থাকলেও তা। তাঁর পক্ষে সব সমান। স্বেচ্ছাক্রমে বিশ্বের সৰ্ব্বত্র তাঁর অবাধ গতি, ব্রহ্মলোক পর্যন্ত। আমিও তাঁকে বলেছিলাম– আর দেহে কেন? উনি বল্লেন–হাম্ তো আত্মানন্দ আত্মারাম, হামারা ওয়াস্তে যো হ্যাঁয় ব্রহ্মলোক, সো মেরা হিমবান, মেরা আসন। এহি পর। পরমাত্মা বিরাজমান হ্যাঁয়। লোকালোক তো মায়া
ক্ষেমদাস বল্লেন–হ্যাঁ, ওসব অনেক উচ্চ অবস্থার কথা। আমাদের জন্যে নয় ওসব। আমরা ভগবানের সৃষ্টির মধ্যে আনন্দ পাই, এই অপূর্ব সৌন্দৰ্য্যরসের আস্বাদ করবে কে আমরা ছাড়া? তোমরা তো ব্রহ্ম হয়ে বাড়ি ছুঁয়ে বুড়ি হয়ে বসে আছ।
পুষ্প কুণ্ঠার সঙ্গে প্রশ্ন করলে–প্রভু, আমাদের একবার সেই সাধুর কাছে নিয়ে গিয়ে দেখাবেন?
সন্ন্যাসী বল্লেন–না মা। তিনি লোকের ভিড় পছন্দ করেন না। তবে চলো আমার পূৰ্ব্বজন্মের আর একটি গুরুভগ্নীর কাছে তোমায় নিয়ে যাবো–তিনিও আজ পর্যন্ত দেহে আছেন। গভীর বনের মধ্যে গুপ্তভাবে থাকেন–প্রায় সময়ই সমাধিস্থ থাকেন। চলো হে কবি, সমাধি দেখলে তোমার জাত যাবে না–
ক্ষেমদাস বল্লেন–না হে, আমি, যাবো না। তুমি এদের নিয়ে। যাও–আমার ও ধর্ম নয়। কবির ধর্ম স্বতন্ত্র।
সন্ন্যাসী হেসে হেসে ক্ষেমদাসের হাত ধরে বল্লেন–ভগবানের মহিমা সৰ্ব্বত্র। কেন যাবে না? চলো–
–বেশ, তাহলে তুমি কথা দাও আমার সঙ্গে ভক্ত বৈষ্ণবের আশ্রমে। যাবে? যদি শ্রীকৃষ্ণকে দেখাতে পারি সেখানে? প্রেমভক্তি নেবে?
দাসী পুনরায় হেসে বল্লেন হবে, হবে। আচ্ছা যাবো, কথা দিলাম। প্রেমভক্তি নিই না নিই স্বতন্ত্র কথা। তোমাকেও তো আমি ষটচক্রভেদ করে অদ্বৈতজ্ঞান পাইয়ে দিচ্চি না জোর করে?
কিছুক্ষণ পরে ওরা সবাই সন্ন্যাসীর পিছু পিছু পৃথিবীর এক স্থানে। নেমে এল। স্থানটি দেখেই ওরা বুঝলে, লোকালয় থেকে বহু দূরে কোনো এক নিবিড় অরণ্যের মধ্যে ওরা দাঁড়িয়ে। সম্মুখে একটি পার্বত্য নদী, কিন্তু নদীগর্ভে কোথাও মাটি বা বালি নেই–সমস্তটা পাষাণময়, চওড়া সমতল, মসৃণ। প্রায় একশো হাত পরিমিত স্থান কি তার চেয়ে বেশি এমনি আপনা-আপনি পাথর-বাঁধানো। তারই মধ্যভাগ। বেয়ে ক্ষুদ্র নদীটি ক্ষুদ্র একটি জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে মর্মর-কলতানে বয়ে চলেছে। উভয় তীরে নিবিড় জঙ্গল, মোটা মোটা লতা এ-গাছ। থেকে ও-গাছে দুলচে; গভীর নিশিথকাল পৃথিবীতে, আকাশে ঠিক মাথার ওপরে চাঁদ, গভীর নিঃশব্দতার মধ্যে পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নালোকে সমস্ত অরণ্যভূমি মায়াময় হয়ে উঠেছে।
ওরা মুগ্ধ হয়ে অপূৰ্ব্ব অরণ্য-দৃশ্য দেখেছে, এমন সময়ে বনের মধ্যে বাঘের গর্জন শোনা গেল, দ্বিতীয়বার শোনা গেল আরও নিকটে। যতীন সভয়ে বলে উঠলো–ওই! চলুন পালাই
অল্প পরেই ওপারের বনের লতাপাতা নিঃশব্দে সরিয়ে প্রকাণ্ড রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হাঁড়ির মত মুখ নদীজলে নামতে দেখা গেল এবং তার জল খাওয়ার ‘চক চক’ শব্দ বনের ঝিল্লীরবের সঙ্গে মিলে। এই গম্ভীর রহস্যময় রজনীর নৈঃশব্দ্য মুখর করে তুলতে লাগলো।
পুষ্প বল্লে–ভয় কি যতীনদা তোমার এখন বাঘের?
ক্ষেমদাস মুগ্ধ দৃষ্টিতে এই অপূৰ্ব্ব শোভাময় জ্যোৎস্নাপ্লাবিত নির্জন বনকান্তারের দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। দুহাত জুড়ে নমস্কার করে। বল্লেন–সুন্দর! নমস্কার হে ভগবান, ধন্য তুমি, আদি কবি তুমি জগৎস্রষ্টা! কর্ণামৃতে ঠিকই বলেচেঃ–মধুগন্ধি…
সন্ন্যাসী বল্লেন–ব্রহ্মই জগৎ হয়ে রয়েছেন, য ওষধিষু যো বনস্পতি–তিনিই সৰ্ব্বত্র। সামনে যা দেখচো এও তিনি, তাঁর বিশ্বরূপের এক রূপ– তবে অত ভাবুকতা আমাদের আসে না, ইনিয়ে-বিনিয়ে বর্ণনা করা আসে না।
ক্ষেমদাস হেসে বল্লেন–আসবে কি হে! তাহোলে তো তুমি উপনিষদ তৈরী করে বসতে। তোমার সঙ্গে উপনিষদের কবিদের তফাৎ তো সেইখানে। তাঁরা ব্ৰহ্মজ্ঞ ছিলেন, আবার কবিও ছিলেন। তোমার মত নীরস ব্রহ্মবিৎ ছিলেন না। ভগবানও কবি। উপনিষদে কি বলেনি। তাঁকে, কবিৰ্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভু?
সন্ন্যাসী বল্লেন–চলো চলো, যে জন্যে এসেচি। উপনিষদে কবি বলেছে যিনি দ্রষ্টা তাঁকে। যিনি প্রজ্ঞার আলোকে এক চমকে ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান দর্শন করেন, চিন্তা দ্বারা যাঁকে বুঝতে হয় না, তিনিই কবি।
যতীন বল্লে–প্রভু, এ কোন্ জায়গা পৃথিবীর?
–এ হোল বাস্তার রাজ্য, মধ্যভারতের। এই নদীর নাম মহানদী, উড়িষ্যার মধ্য দিয়ে সমুদ্রে পড়েছে। এখানে নদীর শৈশবাবস্থা দেখচ, সবে বেরিয়েচে অদূরবর্তী পাহাড়শ্রেণী থেকে। এখন এসো আমার সঙ্গে—
নদীর ওপারে কিছুদূরে ঘন বনে একটি পর্ণ-কুটীরের কাছে ওরা যেতেই একটি সন্ন্যাসিনী তাড়াতাড়ি বার হয়ে এসে ওঁদের অভ্যর্থনা করলেন। বল্লেন–আসুন আপনারা। আমার বড় সৌভাগ্য আজ—
যতীন ও পুষ্পর মনে হোল ইনি যেন ওদের অপেক্ষাতেই ছিলেন। সন্ন্যাসিনীকে দেখে যতীন অবাক হয়ে গেল, সন্ন্যাসী বলেচেন ওঁর পূর্বজন্মের গুরুভগিনী–অথচ ইনি তো কুড়ি বৎসরের তরুণীর মত সুঠাম, সুরূপা, তন্বী। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, রূপ যেন ফেটে পড়েছে, মাথায়। একটাল কালো চুলের রাশ।
সন্ন্যাসী বল্লেন–ভাল আছ ভগ্নী?