হঠাৎ সে দেখলে হাউ হাউ করে কাঁদছে।
একি ব্যাপার! ছিঃ ছিঃ-নাঃ, সে সত্যিই পাগল হবে দেখচি। যতীন। কাঠের গুঁড়িটা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে ব্যস্তভাবে পায়চারি করতে লাগলো। নিজেকে সে সংযত করে নিয়েছে আর সে ও কথাই ভাববে না। যে গিয়েচে, ইচ্ছে করে যে চলে গিয়েছে, তাকে মন থেকে কেটে বাদ দিতে হবে–হবেই। কেটে বাদই দেবে সে।
যতীন বাড়ী ফিরে এল। অন্ধকার বাড়ী, অন্ধকার দোর। ভাঙা তক্তাপোশের ওপর তার রাজশয্যা তো পাতাই আছে। সে ঝাড়েও না, পাতেও না, তোলেও না। অন্ধকারের মধ্যে শয্যায় দেহ প্রসারিত করে শোবার সময় একবার তার মনে হোল–সেই আশা কেমন করে এমন নিষ্ঠুর হতে পারলে!
সেই রাত্রেই যতীনের আবার খুব জ্বর হোল। হয়তো এতখানি পথ যাতায়াত করা, এত ঠাণ্ডা লাগানো দুৰ্ব্বল শরীরে তার উচিত হয় নি। পরদিন দুপুর পর্যন্ত সে অঘোর অচৈতন্য হয়ে পড়ে হইল–কেউ খোঁজ খবর নিলে না। দুপুরের পর বোষ্টদের বৌ ওদের উঠোনে তাদের পোষা ছাগল খুঁজতে এসে অত বেলা পর্যন্ত ঘরের দোর। বন্ধ দেখে বাড়ী গিয়ে খবর দিলে। সে সকালের দিকে আরও দুবার এদিকে কি কাজে এসে দোর বন্ধ দেখে গিয়েছিল।
বিকেলের দিকে সন্ধ্যার কিছু আগে তার জ্বর কমলে সে নিজেই দোর খুললে। কিন্তু এক পাও বাইরে আসতে পারলে না। বিছানায় গিয়েই শুয়ে পড়লো। তৃষ্ণায় তার জিব শুকিয়ে গিয়েছে। কাছাকাছি কারো বাড়ী নেই যে, ডাকলে শুনতে পাবে। বেশি চেঁচানোরও শক্তি নেই।
সকালে কেউ দেখতে এল না। এর একটা কারণ ছিল। যতীনের বাড়ী ইদানীং বড় একটা কেউ আসতো না। এক ছিলিম তামাকও যেখানে খেতে না পাওয়া যাবে, পাড়াগাঁয়ে সে-সব জায়গায় লোক বড় যাতায়াত করে না। কাজেই দুদিন কেটে গেল, যতীনের ঘরের দোর বন্ধ রইল, কেন লোকটা দোর খুলছে না এ দেখবার লোক জুটলো না। পরের দিন অনেক বেলায় বোষ্টম-বৌ আবার ছাগল খুঁজতে এসে অত বেলায় যতীনের দোর বন্ধ দেখে ভাবলে–যতীন ঠাকুর কত বেলা পর্যন্ত ঘুমুচ্চে আজকে!…বেলা দশটা বাজে এখনও সাড়াশব্দ নেই। বেলা বারোটার সময় একবার কি ভেবে আবার এসে দেখলে তখনও দোর বন্ধ। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারলে না! পাড়ার মধ্যে খবরটা বল্লে।
পাড়ার দু-চারটা ষন্ডাগুণ্ডা গোছের যুবক এসে ডাকাডাকি করতে লাগলো।
–ও যতীন-দা, এত বেলায় ঘুম কি, দোর খুলন–ও যতীন-দা–
কেউ সাড়া দিলে না। আরও লোকজন জড় হোলদোর ভাঙা হোল।
যতীন বিছানায় মরে কাঠ হয়ে আছে। কতক্ষণ মরেছে কে জানে, দুঘণ্টাও হতে পারে, দশঘণ্টাও হতে পারে।
তখন সকলে খুব দুঃখ করতে লাগলো। বাস্তবিকই কারো দোষ ছিল না। যতীন লোকটা আজকাল কেমন হয়ে গিয়েছিল, লোকজনের সঙ্গে তেমন করে মিশতো না, কথাবার্তা বলতো না বলে লোকেও এদিকে বড় একটা আসতো না। সুতরাং যতীনের আবার অসুখ হয়েছে, এ খবরও কেউ রাখে না।
নবীন বাঁড়য্যে বল্লেন–আহা, ভবতারণ-দা’র ছেলে! ওর বাবার সঙ্গে একসঙ্গে পাশা খেলেচি আমাদের চণ্ডীমণ্ডপে বসে। লোকটা বেঘোরে মারা গেল। তাই কি আমি জানি ছাই যে এমনি একটা অসুখ হয়েছে (বাস্তবিকই তিনি জানতেন না), আমার স্ত্রী আর আমি এসে রাত জাগতাম। আর সে বৌটিরই বা কি আক্কেল–ছ’ বছরের মধ্যে একবার চোখের দেখা দেখলে না গা–হ্যাঁ?
সকলে একবাক্যে যতীনের বৌ-এর উদ্দেশে বহু গালাগালি করলে।
যতীনের মৃতদেহ যখন শ্মশানে সত্ত্বারের জন্যে নিয়ে যাওয়া হোল, তখন বেলা দুটোর কম নয়।
০৪. যতীন হঠাৎ দেখতে পেলে
যতীন হঠাৎ দেখতে পেলে তার খাটের পাশে পুষ্প দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসচে।…
পুষ্প! এক সময় পুষ্পের চেয়ে তার জীবনে প্রিয়তর কে ছিল?
দুজনে–
নৈহাটির ঘাটে
বসে পৈঠার পাটে
কত খেলেচি ফুল ভাসায়ে জলে–
সেই পুষ্প।
নৈহাটির ঘাট নয়–সাগঞ্জ-কেওটার বুড়োশিবতলার ঘাট। নৈহাটির আড়পারে। সেখানে ছেলেবেলায় তার মাসীমার জীবদ্দশায় সে কতবার গিয়েচে। এক এক সময় ছ’মাস আটমাস মাসীমার কাছেই সে থাকতো। মাসীমার ছেলেপুলে ছিল না, যতীন ছিল তার চক্ষের মণি। তারপর মাসীমা মারা গেলে, মেসোমশায় দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করলেন, সাগঞ্জ-কেওটাতে মাসীমার বাড়ীর দরজা চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে গেল ওর কাছে।
বুড়োশিবতলায় পুরোনো মন্দিরের কাছে ছিল ওর মাসীমার বাড়ী আর রাস্তার ও-পাশেই ছিল পুষ্পদের বাড়ী। পুষ্পর বাবা শ্যামলাল মুখুয্যে বাঁশবেড়ে বাবুদের জমিদারিতে কি কাজ করতেন। পুষ্প ছিল ভারি সুন্দরী মেয়ে–তার হাসি–সে হাসি কেবল পুষ্পই হাসতে পারতো। দোষের মধ্যে পুষ্প ছিল অত্যন্ত গর্বিত মেয়ে। তার বিশ্বাস ছিল তার মত সুন্দরী মেয়ে এবং তার বাবার মত সম্রান্ত লোক গঙ্গার ওপারে কোথাও নেই।
ধীরে ধীরে পুষ্পের সঙ্গে ওর আলাপ হয়, ধীরে ধীরে সে আলাপ জমে। ও তখন তেরো বছরের ছেলে, পুষ্প তেরো বছরের মেয়ে। সমান বয়স হোলে কি হবে, বাচাল ও বুদ্ধিমতী পুষ্পের কাছে যতীন, ভেসে যেতো। পুষ্প চোখে-মুখে কথা কইতো, যতীন সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার গর্বিত সুন্দর মুখের দিকে নীরবে চেয়ে রইত। মস্ত অশ্বত্থ গাছ যে পুরোনো ঘাটটায় ওপরে, যেটার নাম সেকালে ছিল বুড়োশিবতলার ঘাট, ওই ঘাটে কতদিন সে ও পুষ্প একা বসে গল্প করেচে, জগদ্ধাত্রী পূজোর ভাসানের দিন পাঁপরভাজা কিনে ঘাটের রানার ওপর বসে দুজনে ভাগ করে খেয়েচে। কেমন করে যে সেই রূপগৰ্ব্বিতা বালিকা তার মত সাদাসিধে ধরনের বালককে অত পচ্ছন্দ করেছিল, অত দিনরাত মিশতো, নিত্য তাদের বাড়ী না গেলে অনুযোগ করতো–এ সব কথা যতীন জানে না, সে সব বোঝবার বয়েস তখন ওর হয়নি।