যতীন ভীষণ নিরাশ হোল। সে যে কত কি মনে ভেবে এসেছে, আশাকে বলবে–চল আশা, যা হবার তা হয়ে গিয়েচে–ঘরের লক্ষ্মী। ঘরে চলো। কাকে নিয়ে কাটাই বলো তো তুমি যদি এমন করে থাকবে?
তারপর শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস্ করলে–কবে আসবে?
–আসা-আসির এখন ঠিক নেই। এ মাসে তো নয়ই, পূজোর সময় পর্যন্তও থাকতে পারে। এখানে রাঁধবার লোক নেই, বুড়োমানুষ। এতগুলো লোকের ভাতজল করচি দুবেলা, প্রাণ বেরিয়ে গেল।
শেষের কথাটি যে তাকে চলে যাবার ইঙ্গিত, যতীনের তা বুঝতে দেরি হোল না। বিকেলের দিকেই সে ভগ্নমনে বাড়ীর দিকে রওনা হোল। পথে তার খুড়তুতো শালী আন্না, দশ বছরের মেয়ে, অশথ তলায় দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে দেখে কাছে এসে বল্লে–দাদাবাবু, আজই এলেন, আজই চল্লেন যে। রইলেন না?
–না, সব দেখাশুনো করে গেলুম। তা ছাড়া তোর দিদি তো এখানে। নেই, অনেকদিন পরে এলুম, প্রায় বছর দুই পরে, দেখাটা হোল না।
আন্না কেমন এক অদ্ভুত ভাবে ওর দিকে চাইলে–তারপরে এদিক ওদিক চেয়ে সুর নিচু করে বল্লে–একটা কথা বলবো দাদাবাবু, কাউকে বলবেন না আগে বলুন!
যতীন বল্লে–না, বলছি নে। কি কথা রে আন্না?
–দিদি এখানেই আছে, কোথাও যায় নি। আপনার আসবার খবর পেয়ে চৌধুরীদের বাড়ী ওর সই-মার কাছে লুকিয়ে আছে। জ্যাঠাইমা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে আপনার কাছে এসব কথা না বলতে।
যতীন বিস্মিত হয়ে বল্লে–ঠিক বলছিস্ আন্না!
পরেই বালিকার সরল চোখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলে এ প্রশ্ন নিরর্থক। সে দৃষ্টিতে মিথ্যার ভাঁজ ছিল না।
যতীন চলে আসছে, আন্না বল্লে–আজ থেকে গেলেন না কেন। দাদাবাবু?
–না, থাকা হবে না আন্না। বাড়ীতে কাজকর্ম ফেলে এসেচি বুঝলি নে?
আন্না আবার বল্লেদিদিকে একবার চুপি চুপি বলে আসবো যে আপনি চলে যাচ্ছেন, যদি দেখা করে? যাবো দাদাবাবু?
বালিকার সুরে করুণা ও সহানুভূতি মাখানো। সে ছেলেমানুষ হলেও বুঝেছিল যতীনের প্রতি তার শ্বশুরবাড়ীর আচরণের রূঢ়তা। বিশেষ করে তার নিজের স্ত্রীর।
যতীন অবিশ্যি রইল না, চলেই এল।
চলে এল বটে, কিন্তু যে যতীন গিয়েছিল, সে যতীন আর আসে নি। মনভাঙা দেহটা কোনো রকমে বাড়ীতে টেনে এনেছিল মাত্র।
তারপর দীর্ঘ তিন বছর কেটে গিয়েচে। একথা ঠিক যে, সে রকম বেদনা তার মনে এখন আর নেই, থাকলে সে পাগল হয়ে যেতো। সময় তার ক্ষতে অনেকখানি প্রলেপ বুলিয়ে জ্বালা জুড়িয়ে এনেচে। কিন্তু এমন দিন, এমন রাত্রি আসে যখন স্মৃতির দংশন অসহ্য হয়ে ওঠে।
তবুও নীরবে সহ্য করতে হয়। তা ছাড়া আর উপায় কিছু তো নেই। এই ক’বছরের মানসিক যন্ত্রণায় ওর শরীর গিয়েছে, মন গিয়েছে, উৎসাহ নেই, আগ্রহ নেই, অর্থ উপার্জনের স্পৃহা নেই, মান-অপমান বোধ নেই।
যে যা বলে বলুক, দিন কোনো রকমে কেটে গেলেই হোল। কিসে কি এসে যায়? তেলি-তামলির বাড়ী নেমন্তন্ন খেলেই বা কি, রবাহূত অনাহূত গেলেই বা কি, লোকে নিন্দে করলেই বা কি, প্রশংসা করলেই বা কি। কিছু ভাল লাগে না–কিছু ভাল লাগে না।
» ০২. যতীনের পৈতৃক বাড়ীটা
যতীনের পৈতৃক বাড়ীটা নিতান্ত ছোট নয়। পূৰ্বপুরুষেরা এক সময়ে মনের আনন্দে ঘরদোর করে গিয়েচেন। এখন এমন দাঁড়িয়েচে যে সেগুলো মেরামত করবার পয়সা জোটে না। পূৰ্ব্বদিকের আসেটা কাঁঠালের ডাল পড়ে জখম হয়ে গিয়েছে বছর দুই হোল। মিস্ত্রী লাগানোর খরচ হাতে আসে নি বলে তেমনি অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে।
গত ত্রিশ বৎসরের কত পদচিহ্ন এই বাড়ীর উঠোনে। বাবা…মা… বউদিদি… মেজদিদি… পিসিমা দুই ছোট ভাই… আশা… খোকা-খুকীরা…
কত ভালবাসতো সবাই…সব স্বপ্ন হয়ে গেল…কেউ নেই আজ…
সে শিক্ষিত বলে আগে গ্রামের লোক তাকে খুব মেনে চলতো। এখন তারা দেখেচে যে শিক্ষিত হয়েও তার এক পয়সা উপার্জন করবার শক্তি নেই, এতে এখন সবাই তাকে ঘৃণা করে। তার নামে। যা-তা বলে।
আশা যখন প্রথম প্রথম বাপের বাড়ী গিয়েছিল, তখন লজ্জা ও অপমান ঢাকবার জন্যে যতীন গাঁয়ে সকলের কাছে বলে বেড়াতো– শাশুড়ী ঠাকরুণের হাতে অনেক টাকা আছে–কোন্ দিন মরে যাবেন, বয়েস তো হয়েছে। এদিকে বড় মেয়ে প্রায়ই মার কাছে থাকে, পাছে টাকার সবটাই বেহাত হয়ে যায় তাই ও বল্লে–দ্যাখো, এই সময়টা কিছুদিন মার কাছে গিয়ে থাকি গে। নইলে কিছু পাবো না।
এই কৈফিয়ৎ প্রথম প্রথম খুব কার্যকরী হয়েছিল বটে। তারপর বছরের পর বছর কেটে গেল, এখন লোকে নানারকম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। কেউ বলে, অনেকদিন হয়ে গেল, এইবার গিয়ে বৌকে নিয়ে এসো গে যতীন। শাশুড়ীর টাকার মায়া ছেড়ে দাও, বুড়ী সহজে মরবে না।
পিছনে কেউ বলে–এই মোটর গাড়ীর শব্দ ওঠে দ্যাখো না! যতীনের বৌ টাকার পুঁটুলি নিয়ে মোটর থেকে নেমে বলবে–এই নাও পাঁচ হাজার টাকা। তোমার টাকা তুমি রাখো। কি করবে করো–আমি খালাস হই তো আগে! এই ধরো পুঁটুলি।
তা ছাড়া আরও কত রকমের কথা বলে সে সব এখানে ব্যক্ত করবার নয়।
এই সমস্ত ব্যঙ্গ-অপমান যতীনকে বেমালুম হজম করে ফেলতে হয়। সয়ে গিয়েছে, আর লাগে না–মাঝে মাঝে কষ্ট হয় মানুষের নিষ্ঠুরতা বর্বরতা দেখে। একটা সহানুভূতির কথা কেউ বলে না, কেউ এতটুকু দরদ দেখায় নাকি মেয়ে কি পুরুষ! সংসার যে কি ভয়ানক জায়গা, দুঃখে কষ্টে না পড়লে বোঝা যায় না। দুঃখীকে কেউ দয়া করে না, সবাই ঘৃণা করে।