আহারাদি শেষ হয়ে গেল! এখুনি পুকুরের ধারে বাজি পোড়ানো। হবে, কলকাতা থেকে বরপক্ষ ভাল বাজি এনেচে। এসব পাড়াগাঁয়ে অমন কেউ দেখেনি। বাজি দেখবার জন্যে পুকুরের ধারে লোকে লোকারণ্য হয়েছে। যতীনও তাদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো।
হুস্ শব্দে একটা হাউই আকাশে উঠে গিয়ে প্রায় নক্ষত্রের গায়ে ঠেকে ঠেকে তারপর লাল নীল সবুজ ফুল কেটে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে লাগলো।
দলের অনেকে চীৎকার করে উঠলো, আগুন লাগবে। আগুন লাগবে।
দু-চারবার এ রকম তারাবাজি উঠলো নামলো, কারো ঘরের চালে আগুন লাগলো না দেখে উদ্বিগ্ন লোকদের মন শান্ত হোল।
তারাবাজি একটার গায়ে একটা হুস্ করে আকাশে উঠছিল, আর যতীন আশ্চর্য হয়ে সে দিকে চেয়ে দেখচিল একদৃষ্টে ঊর্ধ্বমুখে। বহুদিন ধরে সে পাড়াগাঁয়ে নিতান্ত দুরাবস্থায় পড়ে আছে, অনেকদিন ভাল কিছু দেখে নি। কলকাতার সে ছাত্রজীবন এখন আর মনে পড়ে যেন–সে সব যেন গত জন্মের কাহিনী।
সূতোরগাছির মেঘনাথ চক্কত্তি ওকে দেখে বল্লে–এই যে যতীন। আজ রায়সাহেবের বাড়ী খেলে নাকি? তোমার নেমন্তন্ন ছিল? তা তোমাদের বলতে সাহস করে–কই আমাদের বলুক দিকি? ছোট জাত তিলি-তামলি, না হয় দুটো টাকাই হয়েছে, তা বলে ব্রাহ্মণদের নেমন্তন করে খাওয়াবে বাড়ীতে! তোমরা গিয়ে গিয়ে নিজেদের মান। খুইয়েচ তাই তোমাদের বলতে সাহস করে—ছিঃ–
যতীন যখন বাড়ী পৌঁছলো তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর।
বাঁশবনের মধ্যে সুড়ি পথ পেরিয়ে ওর পৈতৃক আমলের কোঠা। অনেকগুলো ঘরদোর, বাইরের চন্ডীমণ্ডপ, তবে এখন সবই শ্রীহীন। একটা ধানের বড় গোলা ছিল, অর্থকষ্টে পড়ে গত মাঘমাসে সে সাড়ে সাত টাকায় গোলাটা বিক্রী করে ফেলেচে। গোলার ইটে-গাঁথুনির্সিড়ি ক’খানা মাত্র বর্তমান আছে।
আলো জ্বেলে নিজের বিছানাটা পেতে নিয়েই সে আলোটা নিভিয়ে দিলে–তেলের পয়সা জোটে কোথা থেকে যে আলো জ্বালিয়ে রাখবে? অন্ধকারে শূন্য বাড়ীতে একা বসলেই মনে পড়ে আশালতার কথা।
আশালতা কি করে এত নিষ্ঠুর হতে পারলে? বিয়ের পরে প্রথম পাঁচ বছরের কথা মনে হোলে তার বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে। এই ধরনের কত শ্রাবণ-রাত্রিতে ঐ ছাদে সে কত নিভৃত আনন্দ মুহূর্তের কাহিনী এই বাড়ীর বাতাসে আজও বাজে, কত মিষ্টি কথা, কত চাপা হাসি, কত সপ্রেম চাহনি।
মনে পড়ে তারা দুজনে একসঙ্গে তারকেশ্বর গিয়েছিল একবার, তখন যতীনের বড় ছেলেটি আট মাসের শিশু। যাবার আগের দিন রাত্রে আশা রাত একটা পর্যন্ত জেগে খাবার তৈরী করলে। বল্লে, তোমায় কোথাও বাজারের খাবার খেতে দেবো না। নানারকম অসুখ করে যা-তা খাবার খেলে। তার চেয়ে তৈরী করে নিলুম, সস্তাও হবে কেনা খাবারের চেয়ে। ওখানে গিয়ে বাবার প্রসাদ খেলেই চলবে, পথে এই যা করে নিলুম এতেই কুলিয়ে যাবে।
পথে দুষ্টুমি করে যতীন সব খাবার খেয়ে ফেলেছিল নৈহাটি যাবার আগেই, আশাকে ঠকাবার জন্যে। নৈহাটি স্টেশনে খাবার খেতে চাইলে আশা অপ্রতিভ হয়ে পড়লো, খাবার একটুকরোও নেই। যতীন হেসে বল্লে–কেমন, বাজারের খাবার কিনতে হবে না যে বড়! এখন কি হয়?
হয়তো অতি তুচ্ছ ঘটনা। কিন্তু এই তুচ্ছ ঘটনাই পরের পাঁচ ছ’মাস তাদের দুজনকে অফুরন্ত হাসির ফোয়ারা জুগিয়েছিল।–মনে। আছে সেই নৈহাটি স্টেশনের কথা? কি হয়েছিল বল তো?
–যাও যাও, পেটুক গণেশ কোথাকার! আমি কি করে জানবো। যে-ইত্যাদি…
আহা, প্রথম যৌবনের স্বপ্নে রঙীন্ রাগ-সাগরের লীলাচঞ্চল বীচিমালার সে কত চপল নৃত্য! কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে, মিশিয়ে গিয়েচে, অতলতলে তলিয়ে গিয়েছে সে সব দিন–তার ঠিকানা নেই, খোঁজ নেই, খবর নেই।।
সেই আশালতা আছে তার বাপের বাড়ীতে। আজ পাঁচ বছরের মধ্যে একখানা চিঠি দেয়নি যে তার স্বামী বেঁচে আছে না মরেচে। সেও শ্বশুড়বাড়ী যায় না; একবার বছর তিনেক আগে গিয়েছিল, নিতান্ত না থাকতে পেরে। আগে থেকে একখানা চিঠি দিয়েছিল যে সে যাচ্চে।
দুপুরের আগে সে গিয়ে পৌঁছুলো। অনেক আগ্রহ করে গিয়েছিল। শাশুড়ীঠাকরুণ রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে কুটনো কুটছিলেন, তাকে দেখে যেন ভূত দেখলেন। যতীন গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিতেই তিনি উদাসীন সুরে বল্লেন–থা থাক্ হয়েছে, তারপর, এখন কি মনে করে এখানে?
–এই সব দেখাশুনো করতে এলাম। ছেলেমেয়ে সব ভাল আছে? কোথায় সব?
–ঐ যে বাইরের দিকে খেলা করছে–ডেকে দিচ্ছি।
যতীন স্ত্রীর কথাটা লজ্জায় উল্লেখ করতে পারলে না।
ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা করলে। তাদের মায়ের কথা জিজ্ঞেস। করতে গিয়ে যতীনের মনে হোল তারা কি একটা যেন ঢাকচে। ছেলেমেয়েও সব পর হয়ে গিয়েচে, ওর কাছে বড় একটা ঘেঁষতে চায় না আর। ছোট মেয়েটা তো তাকে দেখে নি বল্লেই হয়, আশা যখন চলে এসেছিল তখন খুকীর বয়েস এক বছর মাত্র।
খাওয়া-দাওয়ার সময়েও আশাকে দেখা গেল না। তার ঘরেও নয়। ওর মনে ভয় হোল, আশা বেঁচে আছে তো? লজ্জা ও সঙ্কোচ কাটিয়ে শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করল–ওদের মা কোথায়? দেখচি নে যে?
শাশুড়ী তাড়াতাড়ি বল্লেন–সে এখানে নেই বাপু। সে আজ দিন দশেক হোল গিয়েছে, তার দিদির শ্বশুরবাড়ী বারাসতে। তারা অনেকদিন থেকে নিয়ে যাবে নিয়ে যাবে করছিল, তা আমি বলি যাক বাপু দুদিন একটু বেড়িয়ে আসুক। জীবনে তো তার সুখের সীমা নেই!