কলের বাঁশিতে তিনটার সিটি বাজিল।
ভানুমতী মাথায় করিয়া এঞ্জিনের ঝাড়া কয়লা বাজারে ফিরি করিতে বাহির হইয়াছে-ক-ই-লা চা-ই-ই-চার পয়সা ঝুড়ি।
ভানুমতী তেল আনিয়া সামনে দাঁড়াইল। ওদের বাড়ির সবাই আসিয়া আমাকে নমস্কার করিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইল। ভানুমতীর ছোট কাকা নবীন যুবক জগরু একটা গাছের ডাল ছুলিতে ছুলিতে আসিয়া আমার দিকে চাহিয়া হাসিল। এই ছেলেটিকে আমি বড় পছন্দ করি! রাজপুত্রের মতো চেহারা ওর, কালোর উপরে কি রূপ! এদের বাড়ির মধ্যে এই যুবক এবং ভানুমতী, এদের দুজনকে দেখিলে সত্যই যে ইহারা বন্য জাতির মধ্যে অভিজাতবংশ, তা মনে না হইয়া পারে না।
বলিলাম-কি জগরু, শিকার-টিকার কেমন চলেছে?
জগরু হাসিয়া বলিল-আপনাকে আজই খাইয়ে দেব বাবুজী, ভাববেন না। বলুন কি খাবেন, সজারু না হরিয়াল, না বনমোরগ?
স্নান করিয়া আসিলাম। ভানুমতী নিজের সেই আয়নাখানি (সেবার যেখানা পূর্ণিয়া হইতে আনাইয়া দিয়াছিলাম) আর একখানা কাঠের কাঁকুই চুল আঁচড়াইবার জন্য আনিয়া দিল।
আহারাদির পর বিশ্রাম করিতেছি, বেলা পড়িয়া আসিয়াছে, ভানুমতী প্রস্তাব করিল- বাবুজী চলুন, পাহাড়ে উঠবেন না! আপনি তো ভালবাসেন।
যুগলপ্রসাদ ঘুমাইতেছিল, সে ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিলে আমরা বেড়াইবার জন্য বাহির হইলাম। সঙ্গে রহিল ভানুমতী, ওর খুড়তুতো বোন- জগরু পান্নার মেজ ভাইয়ের মেয়ে, বছর বারো বয়স- আর যুগলপ্রসাদ।
আধ মাইল হাঁটিয়া পাহাড়ের নিচে পৌঁছিলাম।
ধন্ঝরির পাদমূলে এই জায়গায় বনের দৃশ্য এত অপূর্ব যে, খানিকটা দাঁড়াইয়া দেখিতে ইচ্ছা করে। যেদিকে চোখ ফিরাই সেদিকেই বড় বড় গাছ, লতা, উপল-বিছানো ঝরনার খাদ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোট-বড় শিলাস্তূপ। ধন্ঝরির দিকে বন ও পাহাড়ের আড়ালে আকাশটা কেমন সরু হইয়া গিয়াছে, সামনে লাল কাঁকুরে মাটির রাস্তা উঁচু হইয়া ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়া পাহাড়ের ও-পারের দিকে উঠিয়াছে, কেমন খট্খটে শুকনো ডাঙা মাটি, কোথাও ভিজা নয়, স্যাঁতসেঁতে নয়। ঝরনার খাদেও এতটুকু জল নাই।
পাহাড়ের উপরে ঘন বন ঠেলিয়া কিছুদূর উঠিতেই কিসের মধুর সুবাসে মনপ্রাণ মাতিয়া উঠিল, গন্ধটা অত্যন্ত পরিচিত-প্রথমটা ধরিতে পারি নাই, তারপরে চারিদিকে চাহিয়া দেখি-ধন্ঝরি পাহাড়ে যে এত ছাতিম গাছ তাহা পূর্বে লক্ষ্য করি নাই-এখন প্রথম হেমন্তে ছাতিম গাছে ফুল ধরিয়াছে, তাহারই সুবাস।
সে কি দু-চারটি ছাতিম গাছ! সপ্তপর্ণের বন, সপ্তপর্ণ আর কেলিকদম্ব-কদম্বফুলের গাছ নয়, কেলিকদম্ব ভিন্নজাতীয় বৃক্ষ, সেগুনপাতার মতো বড় বড় পাতা, চমৎকার আঁকাবাঁকা ডালপালাওয়ালা বনস্পতিশ্রেণীর বৃক্ষ।
হেমন্তের অপরাহে¦র শীতল বাতাসে পুষ্পিত বন্য সপ্তপর্ণের ঘন বনে দাঁড়াইয়া নিটোল স্বাস্থ্যবতী কিশোরী ভানুমতীর দিকে চাহিয়া মনে হইল, মূর্তিমতী বনদেবীর সঙ্গলাভ করিয়া ধন্য হইয়াছি- কৃষ্ণা বনদেবী। রাজকুমারী তো ও বটেই! এই বনাঞ্চল, পাহাড়, ওই মিছি নদী, কারো নদীর উপত্যকা, এদিকে ধন্ঝরি ওদিকে নওয়াদার শৈলশ্রেণী- এই সমস্ত স্থান একসময়ে যে পরাক্রান্ত রাজবংশের অধীনে ছিল, ও সেই রাজবংশের মেয়ে-আজ ভিন্ন যুগের আবহাওয়ায় ভিন্ন সভ্যতার সংঘাতে যে রাজবংশ বিপর্যস্ত, দরিদ্র, প্রভাবহীন-তাই আজ ভানুমতীকে দেখিতেছি সাঁওতালী মেয়ের মতো। ওকে দেখিলেই অলিখিত ভারতবর্ষের ইতিহাসের এই ট্র্যাজিক অধ্যায় আমার চোখের সামনে ফুটিয়া ওঠে।
আজকার এই অপরাহ্নটি আমার জীবনের আরো বহু সুন্দর অপরাহ্নের সঙ্গে মিলিয়া মধুময় স্মৃতির সমারোহে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল-স্বপ্নের মতো মধুর, স্বপ্নের মতোই অবাস্তব।
ভানুমতী বলিল-চলুন, আরো উঠবেন না?
-কি সুন্দর ফুলের গন্ধ বল তো! একটু বসবে না এখানে? সূর্য অস্ত যাচ্ছে, দেখি-
ভানুমতী হাসিমুখে বলিল-আপনার যা মর্জি বাবুজী। বসতে বলেন এখানে বসি। কিন্তু জ্যাঠামশায়ের কবরে ফুল দেবেন না? আপনি সেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন, আমি রোজ পাহাড়ে উঠি ফুল দিতে। এখন তো বনে কত ফুল।
দূরে মিছি নদী উত্তরবাহিনী হইয়া পাহাড়ের নিচে দিয়া ঘুরিয়া যাইতেছে।
নওয়াদার দিকে যে অস্পষ্ট পাহাড়শ্রেণী, তারই পিছনে সূর্য অস্ত গেল। সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি হাওয়া আরো শীতল হইল। ছাতিম ফুলের সুবাস আরো ঘন হইয়া উঠিল, ছায়া গাঢ় হইয়া নামিল শৈলসানুর বনস্থলীতে, নিন্মের বনাবৃত উপত্যকায়, মিছি নদীর পরপারের গণ্ড-শৈলমালার গাত্রে।
ভানুমতী একগুচ্ছ ছাতিম ফুল পাড়িয়া খোঁপায় গুঁজিল। বলিল- বসব, না উঠবেন বাবুজী?
আবার উঠিতে আরম্ভ করিলাম। প্রত্যেকের হাতে এক-একটা ছাতিম ফুলের ডাল। একেবারে উপরে পাহাড়ের উপরে উঠিয়া গেলাম। সেই প্রাচীন বটগাছটা ও তার তলায় প্রাচীন রাজসমাধি। বড় বড় বাটনাবাটা শিলের মতো পাথর চারিদিকে ছড়ানো। রাজা দোবরু পান্নার কবরের উপর ভানুমতী ও তাহার বোন নিছনী ফুল ছড়াইল, আমি ও যুগলপ্রসাদ ফুল ছড়াইলাম।
ভানুমতী বালিকা তো বটেই, সরলা বালিকার মতোই মহা খুশি। বালিকার মতো আবদারের সুরে বলিল- এখানে একটু দাঁড়াই বাবুজী, কেমন? বেশ লাগছে, না?
আমি ভাবিতেছিলাম- এই শেষ। আর এখানে আসিব না। এ পাহাড়ের উপরকার সমাধিস্থান, এ বনাঞ্চল আর দেখিব না। ধন্ঝরির শৈলচূড়ায় পুষ্পিত সপ্তপর্ণের নিকট, ভানুমতীর নিটক, এই আমার চিরবিদায়। ছ-বছরের দীর্ঘ বনবাস সাঙ্গ করিয়া কলিকাতা নগরীতে ফিরিব- কিন্তু যাইবার দিন ঘনাইয়া আসিবার সঙ্গে সঙ্গে ইহাদের কেন এত বেশি করিয়া জড়াইয়া ধরিতেছি!