তাহার খুপরিতে একদিন গিয়াছিলাম।
নিজের বিঘা পাঁচেক জমি সে নিজের হাতেই পরিষ্কার করিয়া গম বুনিয়াছে। খুপরির চারিপাশে কতগুলি গোঁড়ালেবুর চারা পুঁতিয়াছে।
– এত গোঁড়ালেবুর গাছ কি হবে গিরধারীলাল?
– হুজুর, ওগুলো শরবতী নেবু। আমি বড় খেতে ভালবাসি। চিনি-মিছরি জোটে না আমাদের, ভূরা গুড়ের শরবত করে ওই লেবুর রস দিয়ে খেতে ভারি তার!
দেখিলাম আশার আনন্দে গিরধারীলালের নিরীহ চক্ষু দুটি উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।
– ভালো কলমের লেবু। এক-একটা হবে এক পোয়া। অনেক দিন থেকে আমার ইচ্ছে, যদি কখনো জমি-জায়গা করতে পারি, তবে ভালো শরবতী লেবুর গাছ লাগাব। পরের দোরে লেবু চাইতে গিয়ে কতবার অপমান হয়েছি হুজুর। সে দুঃখ আর রাখব না।
১৮.আরণ্যক – অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ (সমাপ্ত)
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
১
এখান হইতে চলিয়া যাইবার সময় আসিয়াছে। একবার ভানুমতীর সঙ্গে দেখা করিবার ইচ্ছা প্রবল হইল। ধন্ঝরি শৈলমালা একটি সুন্দর স্বপ্নের মতো আমার মন অধিকার করিয়া আছে… তাহার বনানী … তাহার জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রি …
সঙ্গে লইলাম যুগলপ্রসাদকে।
তহসিলদার সজ্জন সিং-এর ঘোড়াটাতে যুগলপ্রসাদ চড়িয়াছিল- আমাদের মহালের সীমানা পার হইতে না-হইতেই বলিল-হুজুর, এ ঘোড়া চলবে না, জঙ্গলের পথে রহল চাল ধরলেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে আমারও পা খোঁড়া হবে। বদলে নিয়ে আসি।
তাহাকে আশ্বস্ত করিলাম। সজ্জন সিং ভালো সওয়ার, সে কতবার পূর্ণিয়ায় মকদ্দমা তদারক করিতে গিয়াছে এই ঘোড়ায়। পূর্ণিয়া যাইতে হইলে কেমন পথে যাইতে হয় যুগলপ্রসাদের তাহা অজ্ঞাত নয় নিশ্চয়ই।
শীঘ্রই কারো নদী পার হইলাম।
তারপর অরণ্য, অরণ্য- সুন্দর অপূর্ব ঘন নির্জন অরণ্য! পূর্বেই বলিয়াছি এ-জঙ্গলে মাথার উপরে গাছপালার ডালে ডালে জড়াজড়ি নাই- কেঁদচারা, শালচারা, পলাশ, মহুয়া, কুলের অরণ্য- প্রস্তরাকীর্ণ রাঙা মাটির ডাঙা, উঁচু-নিচু। মাঝে মাঝে মাটির উপর বন্য হস্তীর পদচিহ্ন। মানুষজন নাই।
হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম লবটুলিয়ার নূতন তৈরি ঘিঞ্জি কুশ্রী টোলা ও বস্তি এবং একঘেয়ে ধূসর, চষা জমি দেখিবার পরে। এ-রকম আরণ্য প্রদেশ এদিকে আর কোথাও নাই।
এই পথের সেই দুটি বন্য গ্রাম- বুরুডি ও কুলপাল- বেলা বারোটার মধ্যেই ছাড়াইলাম। তার পরেই ফাঁকা জঙ্গল পিছনে পড়িয়া রহিল- সম্মুখে বড় বড় বনস্পতির ঘন অরণ্য। কার্তিকের শেষ, বাতাস ঠাণ্ডা- গরমের লেশমাত্রও নাই।
দূরে দূরে ধন্ঝরি পাহাড়শ্রেণী বেশ স্পষ্ট হইয়া ফুটিল।
সন্ধ্যার পরে কাছারিতে পৌঁছিলাম। যে বিড়িপাতার জঙ্গল আমাদের স্টেট নিলামে ডাকিয়া লইয়াছিল, এ-কাছারি সেই জঙ্গলের ইজারাদারের!
লোকটা মুসলমান, শাহাবাদ জেলায় বাড়ি। নাম আবদুল ওয়াহেদ। খুব খাতির করিয়া রাখিয়া দিল। বলিল- সন্ধের সময় পৌঁছেছেন, ভালো হয়েছে বাবুজী। জঙ্গলে বড় বাঘের ভয় হয়েছে।
নির্জন রাত্রি।
বড় বড় গাছে শন্ শন্ করিয়া বাতাস বাধিতেছে।
কাছারির বারান্দায় বসিবার ভরসা পাইলাম না কথাটা শুনিয়া।
ঘরের মধ্যে জানালা খুলিয়া বসিয়া গল্প করিতেছি-হঠাৎ কি একটা জন্তু ডাকিয়া উঠিল বনের মধ্যে। যুগলকে বলিলাম- কি ও?
যুগল বলিল- ও কিছু না, হুড়াল। অর্থাৎ নেকড়ে বাঘ।
একবার গভীর রাত্রে বনের মধ্যে হায়েনার হাসি শোনা গেল-হঠাৎ শুনিলে বুকের রক্ত জমিয়া যায় ভয়ে, ঠিক যেন কাশরোগীর হাসি, মাঝে মাঝে দম বন্ধ হইয়া যায়, মাঝে মাঝে হাসির উচ্ছ্বাস।
পরদিন ভোরে রওনা হইয়া বেলা ন-টার মধ্যে দোবরু পান্নার রাজধানী চক্মকিটোলায় পৌঁছানো গেল। ভানুমতী কি খুশি আমার অপ্রত্যাশিত আগমনে! তার মুখ-চোখে খুশি যেন চাপিতে পারিতেছে না, উপচাইয়া পড়িতেছে।
-আপনার কথা কালও ভেবেছি বাবুজী। এতদিন আসেন নি কেন?
ভানুমতীকে একটু লম্বা দেখাইতেছে, একটু রোগাও বটে। তা ছাড়া মুখশ্রী আছে ঠিক তেমনি লাবণ্যভরা, সেই নিটোল গড়ন তেমনি আছে!
-নাইবেন তো ঝরনায়? মহুয়া তেল আনব না কড়ুয়া তেল? এবার বর্ষায় ঝরনায় কি সুন্দর জল হয়েছে দেখবেন চলুন।
আর একটা জিনিস লক্ষ্য করিয়া আসিতেছি- ভানুমতী ভারি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সাধারণ সাঁওতাল মেয়েদের সঙ্গে তার সেদিক দিয়া তুলনাই হয় না- তার বেশভূষা ও প্রসাধনের সহজ সৌন্দর্য ও রুচিবোধই তাহাকে অভিজাতবংশের মেয়ে বলিয়া পরিচয় দেয়।
যে-মাটির ঘরের দাওয়ায় বসিয়া আছি, তাহার উঠানের চারিধারে বড় বড় আসান ও অর্জুন গাছ। এক ঝাঁক সবুজ বনটিয়া সামনের আসান গাছটার ডালে কলরব করিতেছে। হেমন্তের প্রথম, বেলা চড়িলেও বাতাস ঠাণ্ডা। আমার সামনে আধ মাইলেরও কম দূরে ধন্ঝরি পাহাড়শ্রেণী, পাহাড়ের গা বাহিয়া নামিয়া আসিয়াছে চেরা সিঁথির মতো পথ-একদিকে অনেক দূরে নীল মেঘের মতো দৃশ্যমান গয়া জেলার পাহাড়শ্রেণী।
বিড়ির পাতার জঙ্গল ইজারা লইয়া এই শান্ত জনবিরল বন্য প্রদেশের পল্লবপ্রচ্ছায় উপত্যকার কোনো পাহাড়ী ঝরনার তীরে কুটির বাঁধিয়া বাস করিতাম চিরদিন! লবটুলিয়া তো গেল, ভানুমতীর দেশের এ-বন কেহ নষ্ট করিবে না। এ-অঞ্চলে মরুমকাঁকর ও পাইওরাইট্ বেশি মাটিতে, ফসল তেমন হয় না- হইলে এ-বন কোন্ কালে ঘুচিয়া যাইত। তবে যদি তামার খনি বাহির হইয়া পড়ে, সে স্বতন্ত্র কথা…
তামার কারখানার চিমনি, ট্রলি লাইন, সারি সারি কুলিবস্তি, ময়লা জলের ড্রেন, এঞ্জিনঝাড়া কয়লার ছাইয়ের স্তূপ- দোকানঘর, চায়ের দোকান, সস্তা সিনেমায় ‘জোয়ানী-হাওয়া’ ‘শের শমশের’ ‘প্রণয়ের জের’ (ম্যাটিনিতে তিন আনা, পূর্বাহে¦ আসন দখল করুন)-দেশী মদের দোকান, দরজির দোকান। হোমিও ফার্মেসি (সমাগত দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়)। আদি ও অকৃত্রিম আদর্শ হিন্দু হোটেল।