ঝোপের অন্ধকার হইতে দিনের আলোয় বাহির হইয়া আসিলে দেখিলাম, তাহার বাম হাতে ও বাম পায়ে ভীষণ ক্ষত। বোধ হয় সেইজন্য সে একবার বসিলে বা শুইলে হঠাৎ আর সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না।
মুনেশ্বর সিং বলিল- হুজুর, ওর ওই ঘায়ের জন্যই ওকে বস্তিতে ঢুকতে দেয় না- জল পর্যন্ত চাইলে দেয় না। ঢিল মারে, দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়-
বোঝা গেল তাই এ লোকটা বনের পশুর মতো বন-ঝোপের মধ্যেই আশ্রয় লইয়াছে এই হেমন্তের শিশিরার্দ্র রাত্রে।
বলিলাম- তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়?
লোকটা আমায় দেখিয়া ভয়ে কেমন হইয়া গিয়াছে- ওর চোখে রোগকাতর ও ভীত অসহায় দৃষ্টি। তা ছাড়া আমার পিছনে লাঠিহাতে মুনেশ্বর সিং সিপাহী। বোধ হয় সে ভাবিল, সে যে বনে আশ্রয় লইয়াছে তাহাতেও আমাদের আপত্তি আছে- তাহাকে তাড়াইয়া দিতেই আমি সিপাই সঙ্গে করিয়া সেখানে গিয়াছি।
বলিল- আমার নাম?- নাম হুজুর গিরধারীলাল, বাড়ি তিনটাঙা। পরক্ষণেই কেমন একটা অদ্ভুত সুরে- মিনতি, প্রার্থনা এবং বিকারের রোগীর অসঙ্গত আবদারের সুর এই কয়টি মিলাইয়া এক ধরনের সুরে বলিল- একটু জল খাব- জল-
আমি ততক্ষণে লোকটাকে চিনিয়া ফেলিয়াছি। সেবার পৌষ মাসের মেলায় ইজারাদার ব্রহ্মা মাহাতোর তাঁবুতে সেই যে দেখিয়াছিলাম- সেই গিরধারীলাল। সেই ভীত দৃষ্টি, সেই নম্র মুখের ভাব-
দরিদ্র, নম্র, ভীরু লোকদেরই কি ভগবান জগতে এত বেশি করিয়া কষ্ট দেন! মুনেশ্বর সিংকে বলিলাম- কাছারি যাও- চার-পাঁচজন লোক আর একটা চারপাই নিয়ে এস-
সে চলিয়া গেল।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম- কি হয়েছে গিরধারীলাল? আমি তোমায় চিনি। তুমি আমায় চিনতে পার নি? সেই যে সেবার ব্রহ্মা মাহাতোর তাঁবুতে মেলার সময় তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল- মনে নেই? কোনো ভয় নেই। – কি হয়েছে তোমার?
গিরধারীলাল ঝর্ঝর্ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। হাত ও পা নাড়িয়া দেখাইয়া বলিল- হুজুর, কেটে গিয়ে ঘা হয়। কিছুতেই সে ঘা সারে না, যে যা বলে তাই করি- ঘা ক্রমেই বাড়ে। ক্রমে সকলে বললে- তোর কুষ্ঠ হয়েছে। সেইজন্য আজ চার-পাঁচ মাস এই রকম কষ্ট পাচ্ছি। বস্তির মধ্যে ঢুকতে দেয় না! ভিক্ষে করে কোনো রকমে চালাই। রাত্রে কোথাও জায়গা দেয় না- তাই বনের মধ্যে ঢুকে শুয়ে থাকব বলে-
-কোথায় যাচ্ছিলে এদিকে? এখানে কি করে এলে?
গিরধারীলাল এরই মধ্যে হাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। একটু দম লইয়া বলিল- পূর্ণিয়ার হাসপাতালে যাচ্ছিলাম হুজুর- নইলে ঘা তো সারে না।
আশ্চর্য না হইয়া পারিলাম না। মানুষের কি আগ্রহ বাঁচিবার! গিরধারীলাল যেখানে থাকে, পূর্ণিয়া সেখান হইতে চল্লিশ মাইলের কম নয়- মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের মতো শ্বাপদসঙ্কুল আরণ্যভূমি সামনে- ক্ষতে-অবশ হাত-পা লইয়া সে চলিয়াছে এই দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলের পথ ভাঙিয়া পূর্ণিয়ার হাসপাতালে!
চারপাই আসিল। সিপাহীদের বাসার কাছে একটা খালি ঘরে উহাকে লইয়া গিয়া শোয়াইয়া দিলাম। সিপাহীরাও কুষ্ঠ বলিয়া একটু আপত্তি তুলিয়াছিল, পরে বুঝাইয়া দিতে তাহারা বুঝিল।
গিরধারীকে খুব ক্ষুধার্ত বলিয়া মনে হইল। অনেকদিন সে যেন পেট ভরিয়া খাইতে পায় নাই। কিছু গরম দুধ খাওয়াইয়া দিতে সে কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল।
সন্ধ্যার দিকে তাহার ঘরে গিয়া দেখি সে অঘোরে ঘুমাইতেছে।
পরদিন স্থানীয় বিশিষ্ট চিকিৎসক রাজু পাঁড়েকে ডাকাইলাম। রাজু গম্ভীর মুখে অনেকক্ষণ ধরিয়া রোগীর নাড়ি দেখিল, ঘা দেখিল। রাজুকে বলিলাম-দেখ, তোমার দ্বারা হবে, না পূর্ণিয়ায় পাঠিয়ে দেব?
রাজু আহত অভিমানের সুরে বলিল- আপনার বাপ-মায়ের আশীর্বাদে হুজুর, অনেক দিন এই কাজ করছি। পনের দিনের মধ্যে ঘা ভালো হয়ে যাবে।
গিরধারীকে হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলেই ভালো করিতাম পরে বুঝিলাম। ঘায়ের জন্য নহে, রাজু পাঁড়ের জড়ি-বুটির গুণে পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যেই ঘায়ের চেহারা বদলাইয়া গেল- কিন্তু মুশকিল বাধিল তাহার সেবা-শুশ্রূষা লইয়া। তাহাকে কেহ ছুঁইতে চায় না, ঘায়ে ঔষধ লাগাইয়া দিতে চায় না, তাহার খাওয়া জলের ঘটিটা পর্যন্ত মাজিতে আপত্তি করে।
তাহার উপর বেচারির হইল জ্বর। খুব বেশি জ্বর।
নিরুপায় হইয়া কুন্তাকে ডাকাইলাম। তাহাকে বলিলাম-তুমি বস্তি থেকে একজন গাঙ্গোতার মেয়ে ডেকে দাও, পয়সা দেব-ওকে দেখাশুনো করতে হবে।
কুন্তা কিছুমাত্র না ভাবিয়া তখনই বলিল-আমি করব বাবুজী। পয়সা দিতে হবে না।
কুন্তা রাজপুতের স্ত্রী, সে গাঙ্গোতা রোগীর সেবা করিবে কি করিয়া? ভাবিলাম আমার কথা সে বুঝিতে পারে নাই।
বলিলাম, ওর এঁটো বাসন মাজতে হবে, ওকে খাওয়াতে হবে, ও তো উঠতে পারে না। সে-সব তোমায় দিয়ে কি করে হবে?
কুন্তা বলিল- আপনি হুকুম করলেই আমি সব করব। আমি রাজপুত কোথায় বাবুজী! আমার জাতভাই কেউ এতদিন আমায় কি দেখেছে? আপনি যা বলবেন আমি তাই করব! আমার আবার জাত কি!
রাজু পাঁড়ের জড়ি-বুটির গুণে ও কুন্তার সেবাশুশ্রূষায় মাসখানেকের মধ্যে গিরধারীলাল চাঙ্গা হইয়া উঠিল! কুন্তা এজন্য দিতে গেলেও কিছু লইল না। গিরধারীলালকে সে ইতিমধ্যে ‘বাবা’ বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে দেখিলাম। বলিল- আহা, বাবা বড় দুঃখী, বাবার সেবা করে আবার পয়সা নেব? ধরমরাজ মাথার উপর নেই?
জীবনে যে কয়টি সৎ কাজ করিয়াছি, তাহার মধ্যে একটি প্রধান সৎ কাজ নিরীহ ও নিঃস্ব গিরধারীলালকে বিনা সেলামিতে কিছু জমি দিয়া লবটুলিয়াতে বাস করানো।