এই সময় মটুকনাথ পণ্ডিত আসিল। আজকাল মটুকনাথের টোলে প্রায় পনরটি ছাত্র কলাপ ও মুগ্ধবোধ পড়ে। তাহার অবস্থা আজকাল ফিরিয়া গিয়াছে। গত ফসলের সময় যজমানদের ঘর হইতে এত গম ও মকাই পাইয়াছে যে, টোলের উঠানে তাহাকে একটা ছোট গোলা বাঁধিতে হইয়াছে!
অধ্যবসায়ী লোকের উন্নতি যে হইতেই হইবে- মটুকনাথ পণ্ডিত তাহার অকাট্য প্রমাণ।
উন্নতি! -আবার সেই উন্নতির কথা আসিয়া পড়িল।
কিন্তু উন্নতির কথা না আসিয়া উপায় নাই। চোখের উপর দেখিতে পাইতেছি মটুকনাথ উন্নতি করিয়াছে বলিয়াই তাহার আজকাল খুব খাতির সম্মান- আমার কাছারির যে-সব সিপাহী ও আমলা মটুকনাথকে পাগল বলিয়া উপেক্ষা করিত-গোলাবাঁধার পর হইতে আমি লক্ষ্য করিতেছি তাহারা মটুকনাথকে সম্মান ও খাতির করিয়া চলে। সঙ্গে সঙ্গে টোলের ছাত্রসংখ্যাও যেন বাড়িয়া চলিয়াছে। অথচ যুগলপ্রসাদ বা গনোরী তেওয়ারীকে কেউ পোঁছেও না। রাজু পাঁড়েও নবাগত প্রজাদের মধ্যে খুব খাতির জমাইয়া ফেলিয়াছে-জড়িবুটির পুঁটুলি হাতে তাহাকে প্রায়ই দেখা যায় গৃহস্থবাড়ির ছেলেমেয়েদের নাড়ি টিপিয়া বেড়াইতেছে। তবে রাজু পাঁড়ে পয়সা তেমন বোঝে না, খাতির পাইয়া ও গল্প করিয়াই সন্তুষ্ট।
৪
মাস তিন-চারের মধ্যে মহালিখারূপের পাহাড়ের কোল হইতে লবটুলিয়া ও নাঢ়া-বইহারের উত্তর সামীনা পর্যন্ত প্রজা বসিয়া গেল। পূর্বে জমি বিলি হইয়া চাষ আরম্ভ হইয়াছিল বটে, কিন্তু লোকের বাস এত হয় নাই- এ বছর দলে দলে লোক আসিয়া রাতারাতি গ্রাম বসাইয়া ফেলিতে লাগিল।
কত ধরনের পরিবার। শীর্ণ টাট্টু ঘোড়ার পিঠে বিছানাপত্র, বাসন, পিতলের ঘয়লা, কাঠের বোঝা, গৃহদেবতা, তোলা উনুন চাপাইয়া একটি পরিবারকে আসিতে দেখা গেল। মহিষের পিঠে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, হাঁড়িকুড়ি, ভাঙ্গা লণ্ঠন, এমন কি চারপাই পর্যন্ত চাপাইয়া আর এক পরিবার আসিল। কোনো কোনো পরিবারে স্বামী-স্ত্রীতে মিলিয়া জিনিসপত্র ও শিশুদের বাঁকের দু-দিকে চাপাইয়া বাঁক কাঁধে বহুদূর হইতে হাঁটিয়া আসিতেছে।
ইহাদের মধ্যে সদাচারী, গর্বিত মৈথিল ব্রাহ্মণ হইতে আরম্ভ করিয়া গাঙ্গোতা ও দোসাদ পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের লোকই আছে। যুগলপ্রসাদ মুহুরীকে জিজ্ঞাসা করিলাম-এরা কি এতদিন গৃহহীন অবস্থায় ছিল? এত লোক আসছে কোথা থেকে?
যুগলপ্রসাদের মন ভালো নয়। বলিল-এদেশের লোকই এই রকম। শুনেছে এখানে জমি সস্তায় বিলি হচ্ছে-তাই দলে দলে আসছে। সুবিধে বোঝে থাকবে, নয়তো আবার ডেরা উঠিয়ে অন্য জায়গায় ভাগবে।
-পিতৃপিতামহের ভিটের কোনো মায়া নেই এদের কাছে?
-কিছু না বাবুজী। এদের উপজীবিকাই হচ্ছে নূতন-ওঠা চর বা জঙ্গলমহাল বন্দোবস্ত নিয়ে চাষবাস করা। বাস করাটা আনুষঙ্গিক। যতদিন ফসল ভালো হবে, খাজনা কম থাকবে, ততদিন থাকবে।
-তারপর?
-তারপর খোঁজ নেবে অন্য কোথায় নূতন চর বা জঙ্গল বিলি হচ্ছে, সেখানে চলে যাবে। এদের ব্যবসাই এই।
৫
সেদিন গ্র্যাণ্ট সাহেবের বটগাছের নিচে জমি মাপিয়া দিতে গিয়াছি, আস্রফি টিণ্ডেল জমি মাপিতেছিল, আমি ঘোড়ার উপর বসিয়া দেখিতেছিলাম, এমন সময় কুন্তাকে টোলার পথ ধরিয়া যাইতে দেখিলাম।
কুন্তাকে অনেকদিন দেখি নাই। আস্রফিকে বলিলাম-কুন্তা আজকাল কোথায় থাকে, ওকে দেখি নি তো?
আস্রফি বলিল-ওরা কথা শোনেন নি বাবুজী? ও মধ্যে এখানে ছিল না অনেক দিন-
-কি রকম?
-রাসবিহারী সিং ওকে নিয়ে যায় তার বাড়ি। বলে, তুমি আমাদের জাতভাইয়ের স্ত্রী-আমার এখানে এসে থাক-
– বেশ।
– সেখানে কিছুদিন থাকবার পরে- ওর চেহারা দেখেছেন তো বাবুজী, এত দুঃখে কষ্টে এখনো- তারপর রাসবিহারী সিং কি-সব কথা বলে- এমন কি ওর উপর অত্যাচারও করতে যায়- তাই আজ মাসখানেক হোলো সেখান থেকে পালিয়ে এসে আছে। শুনি রাসবিহারী ছোরা নিয়ে ভয় দেখায়। ও বলেছিল, মেরে ফেল বাবুজী, জান দেগা-ধরম দেগা নেহিন।
– কোথায় থাকে?
– ঝল্লুটোলায় এক গাঙ্গোতার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের গোয়ালঘরের পাশে একখানা ছোট্ট চালা আছে সেখানেই থাকে।
– চলে কি করে? ওর তো দু-তিনটি ছেলেমেয়ে।
– ভিক্ষে করে-ক্ষেতের ফসল কুড়োয়। কলাই গম কাটে। বড় ভালো মেয়ে বাবু কুন্তা। বাইজীর মেয়ে ছিল বটে, কিন্তু ভালো ঘরের মেয়ের মতো মন-মেজাজ- কোনো অসৎ কাজ ওকে দিয়ে হবে না।
জরিপ শেষ হইল। বালিয়া জেলার একটি প্রজা এই জমি বন্দোবস্ত লইয়াছে- কাল হইতে এখানে সে বাড়ি বাঁধিবে। গ্র্যাণ্ট সাহেবের বটগাছের মহিমাও ধ্বংস হইল।
মহালিখারূপের পাহাড়ের উপরকার বড় বড় গাছপালার মাথায় রোদ রাঙা হইয়া আসিল। সিল্লীর দল ঝাঁক বাঁধিয়া সরস্বতী কুণ্ডীর দিকে উড়িয়া চলিয়াছে। সন্ধ্যার আর দেরি নাই।
একটা কথা ভাবিলাম।
এতটুকু জমি কোথাও থাকিবে না এই বিশাল লবটুলিয়া ও নাঢ়া-বইহারে, যেমন দেখিতেছি। দলে দলে অপরিচিত লোক আসিয়া জমি লইয়া ফেলিল- কিন্তু এই আরণ্যভূমিতে যাহারা চিরকাল মানুষ অথচ যাহারা নিঃস্ব, হতভাগ্য- জমি বন্দোবস্ত লইবার পয়সা নাই বলিয়াই কি তাহারা বঞ্চিত থাকিবে? যাহাদের ভালবাসি, তাহাদের অন্তত এতটুকু উপকার করিবই।
আস্রফিকে বলিলাম- আস্রফি, কুন্তাকে কাল সকালে কাছারিতে হাজির করতে পারবে? ওকে একটু দরকার আছে।
– হাঁ, হুজুর, যখন বলবেন।
পরদিন সকালে কুন্তাকে আস্রফি আমার আপিসঘরের সামনে বেলা ন’টার সময় লইয়া আসিল।