কি হইতে যেন মনে অকারণ আনন্দের বান ডাকিল তাহা জানি না। জ্যোৎস্নারাত্রি- তখনই ঘোড়ায় জিন কষিয়া সরস্বতী কুণ্ডীর দিকে রওনা হইলাম, কারণ তখন নাঢ়া ও লবটুলিয়া বইহারের বনরাজি শেষ হইয়া আসিয়াছে- যাহা কিছু অরণ্যশোভা ও নির্জনতা আছে তখনো সরস্বতীর তীরেই। আমি মনে মনে বেশ বুঝিলাম, এ আনন্দকে উপভোগ করিবার একমাত্র পটভূমি হইতেছে সরস্বতী হ্রদের তীরবর্তী বনানী।
ঐ সরস্বতীর জল জ্যোৎস্নালোকে চিক্চিক্ করিতেছে-চিক্চিক্ করিতেছে কি শুধু? ঢেউয়ে ঢেউয়ে জ্যোৎস্না ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। নির্জন, স্তব্ধ বনানী হৃদের জলের তিন দিকে বেষ্টন করিয়া, বন্য লাল হাঁসের কাকলি, বন্য শেফালি-পুষ্পের সৌরভ, কারণ যদিও জ্যৈষ্ঠ মাস, শেফালিফুল এখানে বারোমাস ফোটে।
কতক্ষণ হ্রদের তীরে এদিকে ওদিকে ইচ্ছামতো ঘোড়া চালাইয়া বেড়াইলাম। হ্রদের জলে পদ্ম ফুটিয়াছে, তীরের দিকে ওয়াটারক্রোফ্ট ও যুগলপ্রসাদের আনীত স্পাইডার লিলির ঝাড় বাঁধিয়াছে। দেশে চলিয়াছি কতকাল পরে, এ নির্জন অরণ্যবাস হইতে মুক্তি পাইব, সেখানে বাঙালি মেয়ের হাতে রান্না খাদ্য খাইয়া বাঁচিব, কলিকাতায় এক-আধ দিন থিয়েটার-বায়োস্কোপ দেখিব, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কত কাল পরে আবার দেখা হইবে।
এইবার ধীরে ধীরে সে অননুভূত আনন্দের বন্যা আমার মনের কূল ভাসাইয়া দোলা দিতে লাগিল। যোগাযোগ হইয়াছিল বোধ হয় অদ্ভুত-এতদিন পরে দেশে প্রত্যাবর্তন, সরস্বতী হ্রদের জ্যোৎস্নালোকিত-বারিরাশি ও বনফুলের শোভা, বন্য শেফালির জ্যোৎস্না-মাখানো সুবাস, শান্ত স্তব্ধতা-ভালো ঘোড়ার চমৎকার কোনাকুনি ক্যাণ্টার চাল, হু-হু হাওয়া- সব মিলিয়া স্বপ্ন! স্বপ্ন! আনন্দের ঘন নেশা! আমি যেন যৌবনোন্মত্ত তরুণ দেবতা, বাধাবন্ধহীন, মুক্ত গতিতে সময়ের সীমা পার হইয়া চলিয়াছি-এই চলাই যেন আমার অদৃষ্টের জয়লিপি, আমার সৌভাগ্য, আমার প্রতি কোন্ সুপ্রসন্ন দেবতার আশীর্বাদ!
হয়তো আর ফিরিব না-দেশে ফিরিয়া মরিয়াও তো যাইতে পারি। বিদায় সরস্বতী-কুণ্ডী, বিদায় তীরতরু-সারি, বিদায় জ্যোৎস্নালোকিত মুক্ত বনানী। কলিকাতার কোলাহলমুখর রাজপথে দাঁড়াইয়া তোমার কথা মনে পড়িবে, বিস্তৃত জীবনদিনের বীণার অনতিস্পষ্ট ঝঙ্কারের মতো মনে পড়িবে যুগলপ্রসাদের আনা গাছগুলির কথা, জলের ধারে স্পাইডার লিলি ও পদ্মের বন, তোমার বনের নিবিড় ডালপালার মধ্যে স্তব্ধ মধ্যাহ্নে ঘুঘুর ডাক, অস্তমেঘের ছায়ায় রাঙা ময়নাকাঁটার গুঁড়ি ও ডাল, তোমার নীল জলে উপরকার নীল আকাশে উড়ন্ত সিল্লী ও লাল হাঁসের সারি-জলের ধারের নরম কাদার উপরে হরিণশিশুর পদচিহ্ন … নির্জনতা, সুগভীর নির্জনতা। বিদায়, সরস্বতী কুণ্ডী।
ফিরিবার পথে দেখি সরস্বতী হ্রদের বন হইতে বাহির হইয়া মাইলখানেক দূরে একটা জায়গায় বন কাটিয়া একখানা ঘর বসাইয়া মানুষ বাস করিতেছে- এই জায়গাটার নাম হইয়াছে নয়া লবটুলিয়া-যেমন নিউ সাউথ ওয়েল্স্ বা নিউ ইয়র্ক- নূতন গৃহস্থ পরিবার আসিয়া বনের ডালপালা কাটিয়া (নিকটে বড় বন নাই, সুতরাং সরস্বতীর তীরবর্তী বন হইতেই আমদানি নিশ্চয়ই) ঘাসের ছাওয়া তিন-চারখানা নিচু নিচু খুপরি বাঁধিয়াছে। তারই নিচে এখনো পর্যন্ত ভিজা দাওয়ার উপর একটা নারিকেল কিংবা কড়ুয়া তেলের গলা-ভাঙ্গা বোতল, একটি উলঙ্গ হামাগুড়িরত কৃষ্ণকায় শিশু, কয়েকটি সিহোড়া গাছের সুরু ডালে বোনা ঝুড়ি, একটি মোটা রূপার অনন্ত পরা যক্ষের মতো কালো আঁটসাঁট গড়নের বউ, খানকয়েক পিতলের লোটা ও থালা ও কয়েকখানা দা, খোন্তা, কোদাল। ইহাই লইয়া ইহারা প্রায় সবাই সংসার করে। শুধু নিউ লবটুলিয়া কেন, ইসমাইলপুর ও নাঢ়া-বইহারের সর্বত্রই এইরূপ। কোথা হইতে উঠিয়া আসিয়াছে তাই ভাবি; ভদ্রাসন নাই, পৈতৃক ভিটা নাই, গ্রামের মায়া নাই, প্রতিবেশীর স্নেহমমতা নাই-আজ ইসমাইলপুরের বনে, কাল মুঙ্গেরের দিয়ারা চরে, পরশু জয়ন্তী পাহাড়ের নিচে তরাইভূমিতে -সর্বত্রই ইহাদের গতি, সর্বত্রই ইহাদের ঘর।
পরিচিত কণ্ঠের আওয়াজ পাইয়া দেখি রাজু পাড়ে এই ধরনের একটি গৃহস্থবাড়িতে বসিয়া ধর্মতত্ত্ব আলোচনা করিতেছে। উহাকে দেখিয়া ঘোড়া হইতে নামিলাম। আমায় সবাই মিলিয়া খাতির করিয়া বসাইল। রাজুকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম সে এখানে কবিরাজি করিতে আসিয়াছিল। ভিজিট পাইয়াছে চারিকাঠা যব এবং নগদ আট পয়সা। ইহাতেই সে মহা খুশি হইয়া ইহাদের সহিত আসর জমাইয়া দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা জুড়িয়া দিয়াছে।
আমায় বলিল-বসুন, একটা কথার মীমাংসা করে দিন তো বাবুজী! আচ্ছা, পৃথিবীর কি শেষ আছে? আমি তো এদের বলছি বাবু, যেমন আকাশের শেষ নেই, পৃথিবীরও তেমনি শেষ নেই। কেমন, তাই না বাবুজী?
বেড়াইতে আসিয়া এমন গুরুতর জটিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সম্মুখীন হইতে হইবে, তাহা ভাবি নাই।
রাজু পাঁড়ের দার্শনিক মন সর্বদাই জটিল তত্ত্ব লইয়া কারবার করে জানি এবং ইহাও জানি যে ইহাদের সমাধানে সে সর্বদাই মৌলিক চিন্তার পরিচয় দিয়া আসিতেছে, যেমন রামধনু উইয়ের ঢিবি হইতে জন্মায়, নক্ষত্রদল যমের চর, মানুষ কি পরিমাণে বাড়িতেছে তাহাই সরেজমিনে তদারক করিবার জন্য যম কর্তৃক উহারা প্রেরিত হয়-ইত্যাদি।
পৃথিবীতত্ত্ব যতটা আমার জানা আছে বুঝাইয়া বলিতে রাজু বলিল- কেন সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, পশ্চিমে অস্ত যায়, আচ্ছা কোন্ সাগর থেকে সূর্য উঠছে আর কোন্ সাগরে নামছে এর কেউ নিরাকরণ করতে পেরেছে? রাজু সংস্কৃত পড়িয়াছে, ‘নিরাকরণ’ কথাটা ব্যবহার করাতে গাঙ্গোতা গৃহস্থ ও তাহার পরিবারবর্গ সপ্রশংস ও বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে রাজুর দিকে চাহিয়া রহিল এবং সঙ্গে সঙ্গে ইহাও ভাবিল ইংরেজিনবিশ বাঙালি বাবুকে কবিরাজমশায় একেবারে কি অথৈ জলে টানিয়া লইয়া ফেলিয়াছে! বাঙালি বাবু এবার হাবুডুবু খাইয়া মরিল দেখিতেছি!
বলিলাম-রাজু, তোমার চোখের ভুল, সূর্য কোথাও যায় না, এক জায়গায় স্থির আছে।