ধাতুরিয়া তাহার পর বসিয়া বসিয়া নৃত্যশিল্পের বিষয়ে নানা কথা কি সব বলিল, আমি তত বুঝিলাম না। পূর্ণিয়ার হো-হো-নাচের ভঙ্গির সঙ্গে ধরমপুর অঞ্চলের ঐ শ্রেণীর নাচের কি তফাৎ-সে নিজে নূতন কি একটা হাতের মুদ্রা প্রবর্তন করিয়াছে- এইসব ধরনের কথা।
-বাবুজী, আপনি বালিয়া জেলায় ছট্ পরবের সময় মেয়েদের নাচ দেখেছেন? ওর সঙ্গে ছক্কর-বাজি নাচের বেশ মিল থাকে একটা জায়গায়। আপনাদের দেশে নাচ কেমন হয়?
আমি তাহাকে গত বৎসর ফসলের মেলায় দৃষ্ট ননীচোর নাটুয়া’র নাচের কথা বলিলাম। ধাতুরিয়া হাসিয়া বলিল- ও কিছু না বাবুজী, ও মুঙ্গেরের গেঁয়ো নাচ। গাঙ্গোতাদের খুশি করবার নাচ। ওর মধ্যে খাঁটি জিনিস কিছু নেই। ও তো সোজা।
বলিলাম- তুমি জানো? নেচে দেখাও তো?
ধাতুরিয়া দেখিলাম নিজের শাস্ত্রে বেশ অভিজ্ঞ। ‘ননীচোর নাটুয়ার’ নাচ সত্যিই চমৎকার নাচিল- সেই খুঁত খুঁত করিয়া ছেলেমানুষের মতো কান্না, সেই চোরা ননী বিতরণ করিবার ভঙ্গি- সেইসব। তাহাকে আরো মানাইল এইজন্য যে, সে সত্যিই বালক।
ধাতুরিয়া বিদায় লইয়া চলিয়া গেল। যাইবার সময় বলিল-এত মেহেরবানিই যখন করলেন বাবুজী, একবার কলকাতায় কেন নিয়ে চলুন না? ওখানে নাচের আদর আছে।
এই ধাতুরিয়ার সহিত আমার শেষ দেখা।
মাস দুই পরে শোনা গেল, বি এন ডব্লিউ রেল লাইনের কাটারিয়া স্টেশনের অদূরে লাইনের উপর একটি বালকের মৃতদেহ পাওয়া যায়-নাটুয়া বালক ধাতুরিয়ার মৃতদেহ বলিয়া সকলে চিনিয়াছে। ইহা আত্মহত্যা কি দুর্ঘটনা তাহা বলিতে পারিব না। আত্মহত্যা হইলে, কি দুঃখেই বা সে আত্মহত্যা করিল?
সেই বন্য অঞ্চলে দু-বছর কাটাইবার সময় যতগুলি নরনারীর সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম- তার মধ্যে ধাতুরিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তাহার মধ্যে যে একটি নির্লোভ, সদাচঞ্চল, সদানন্দ, অবৈষয়িক, খাঁটি শিল্পীমনের সাক্ষাৎ পাইয়াছিলাম, শুধু সে বন্য দেশ কেন, সভ্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যেও তা সুলভ নয়!
৫
আরো তিন বৎসর কাটিয়া গেল।
নাঢ়া-বইহার ও লবটুলিয়ার সমুদয় জঙ্গলমহাল বন্দোবস্ত হইয়া গিয়াছে। এখন আর কোথাও পূর্বের মতো বন নাই। প্রকৃতি কত বৎসর ধরিয়া নির্জনে নিভৃতে যে কুঞ্জ রচনা করিয়া রাখিয়াছিল, কত কেঁয়োঝাঁকার নিভৃত লতাবিতান, কত স্বপ্নভূমি-জনমজুরেরা নির্মম হাতে সব কাটিয়া উড়াইয়া দিল, যাহা গড়িয়া উঠিয়াছিল পঞ্চাশ বৎসরে, তাহা গেল এক দিনে। এখন কোথাও আর সে রহস্যময় দূরবিসর্পী প্রান্তর নাই, জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রিতে যেখানে মায়াপরীরা নামিত, মহিষের দেবতা দয়ালু টাঁড়বারো হাত তুলিয়া দাঁড়াইয়া বন্য মহিষদলকে ধ্বংস হইতে রক্ষা করিত।
নাঢ়া-বইহার নাম ঘুচিয়া গিয়াছে, লবটুলিয়া এখন একটি বস্তি মাত্র। যে দিকে চোখ যায়, শুধু চালে চালে লাগানো অপকৃষ্ট খোলার ঘর। কোথাও বা কাশের ঘর। ঘন ঘিঞ্জি বসতি-টোলায় টোলায় ভাগ করা- ফাঁকা জায়গায় শুধুই ফসলের ক্ষেত। এতটুকু ক্ষেতের চারিদিকে ফনিমনসার বেড়া। ধরণীর মুক্তরূপ ইহারা কাটিয়া টুকুরা টুকরা করিয়া নষ্ট করিয়া দিয়াছে।
আছে কেবল একটি স্থান, সরস্বতী কুণ্ডীর তীরবর্তী বনভূমি।
চাকুরির খাতিরে মনিবের স্বার্থরক্ষার জন্য সব জমিতেই প্রজাবিলি করিয়াছি বটে, কিন্তু যুগলপ্রসাদের হাতে সাজানো সরস্বতী-তীরের অপূর্ব বনকু কিছুতেই প্রাণ ধরিয়া বন্দোবস্ত করিতে পারি নাই। কতবার দলে দলে প্রজারা আসিয়াছে সরস্বতী কুণ্ডীর পাড়ের জমি লইতে- বর্ধিত হারে সেলামি ও খাজনা দিতেও চাহিয়াছে, কারণ একে ঐ জমি খুব উর্বরা, তাহার উপর নিকটে জল থাকায় মকাই প্রভৃতি ভালো জন্মাইবে; কিন্তু আমি রাজি হই নাই।
তবে কতদিন আর রাখিতে পারিব? সদর আপিস হইতে মাঝে মাঝে চিঠি আসিতেছে সরস্বতী কুণ্ডীর জমি আমি কেন বিলি করিতে বিলম্ব করিতেছি। নানা ওজর-আপত্তি তুলিয়া এখনো পর্যন্ত রাখিয়াছি বটে, কিন্তু বেশি দিন পারিব না। মানুষের লোভ বড় বেশি, দুটি ভুট্টার ছড়া আর চীনাঘাসের এককাঠা দানার জন্য প্রকৃতির অমন স্বপ্নকু ধ্বংস করিতে তাহাদের কিছুমাত্র বাধিবে না, জানি। বিশেষ করিয়া এখানকার মানুষে গাছপালার সৌন্দর্য বোঝে না, রম্য ভূমিশ্রীর মহিমা দেখিবার চোখ নাই, তাহারা জানে পশুর মতো পেটে খাইয়া জীবনযাপন করিতে। অন্য দেশ হইলে আইন করিয়া এমন সব স্থান সৌন্দর্যপিপাসু প্রকৃতিরসিক নরনারীর জন্য সুরক্ষিত করিয়া রাখিত, যেমন আছে কালিফোর্নিয়ার যোসেমাই ন্যাশনাল পার্ক, দক্ষিণ আফ্রিকায় আছে ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক, বেলজিয়ান কঙ্গোতে আছে পার্ক ন্যাশনাল আলবার্ট। আমার জমিদাররা ও ল্যাণ্ডস্কেপ বুঝিবে না, বুঝিবে সেলামির টাকা, খাজনার টাকা, আদায় ইরশাল, হস্তবুদ।
এই জন্মান্ধ মানুষের দেশে একজন যুগলপ্রসাদ কি করিয়া জন্মিয়াছিল জানি না- শুধু তাহারই মুখের দিকে চাহিয়া আজও সরস্বতী হ্রদের তীরবর্তী বনানী অক্ষুন্ন রাখিয়াছি।
কিন্তু কতদিন রাখিতে পারিব?
যাক্, আমারও কাজ শেষ হইয়া আসিল বলিয়া।
প্রায় তিন বছর বাংলা দেশে যাই নাই- মাঝে মাঝে বাংলা দেশের জন্য মন বড় উতলা হয়। সারা বাংলা দেশ আমার গৃহ- তরুণী কল্যাণী বধূ সেখানে আপন হাতে সন্ধ্যাপ্রদীপ দেখায়; এখানকার এমন লক্ষ্মীছাড়া উদাস ধূ ধূ প্রান্তর ও ঘন বনানী নয়- যেখানে নারীর হাতের স্পর্শ নাই।