ভানুমতী চলিতে চলিতে থামিয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিল- বাবুজী, উঠতে কষ্ট হচ্ছে?
-কিছু না। একটু আস্তে চল কেবল-কষ্ট কি।
আর খানিকটা চলিয়া সে বলিল-জ্যাঠামশাই চলে গেল, সংসারে আমার আর কেউ রইল না, বাবুজী-
ভানুমতী ছেলেমানুষের মতো কাঁদ-কাঁদ হইয়া কথাটা বলিল।
উহার কথা শুনিয়া আমার হাসি পাইল। বৃদ্ধ প্রপিতামহই না হয় মারা গিয়াছে, মাও নাই, নতুবা উহার বাবা, ভাই, ঠাকুরমা, ঠাকুরদা সবাই বাঁচিয়া, চারিদিকে জাজ্বল্যমান সংসার। হাজার হোক, ভানুমতী স্ত্রীলোক এবং বালিকা, পুরুষের একটু সহানুভূতি আকর্ষণ করিবার ও মেয়েলি আদর-কাড়ানোর প্রবৃত্তি তার পক্ষে স্বাভাবিক।
ভানুমতী বলিল-আপনি মাঝে মাঝে আসবেন বাবুজী, আমাদের দেখাশুনো করবেন-ভুলে যাবেন না বলুন-
নারী সব জায়গায় সব অবস্থাতেই সমান। বন্য বালিকা ভানুমতীও সেই একই ধাতুতে গড়া!
বলিলাম-কেন ভুলে যাব? মাঝে মাঝে আসব নিশ্চয়ই-
ভানুমতী কেমন একরকম অভিমানের সুরে ঠোঁট ফুলাইয়া বলিল- হাঁ, বাংলা দেশে গেলে, কলকাতা শহরে গেলে আপনার আবার মনে থাকবে এ পাহাড়ে জংলী দেশের কথা-একটু থামিয়া বলিল-আমাদের কথা-আমার কথা-
স্নেহের সুরে বলিলাম-কেন, মনে ছিল না ভানুমতী? আয়নাখানা পাও নি? মনে ছিল কি ছিল না ভাব-
ভানুমতী উজ্জ্বল মুখে বলিল- উঃ বাবুজী, বড় চমৎকার আয়না-সত্যি, সে-কথা আপনাকে জানাতে ভুলেই গিয়েছি!
সমাধিস্থানের সেই বটগাছের তলায় যখন গিয়া দাঁড়াইলাম, তখন বেলা নাই বলিলেও হয়, দূর পাহাড়শ্রেণীর আড়ালে সূর্য লাল হইয়া ঢলিয়া পড়িতেছে, কখন ক্ষীণাঙ্গ চাঁদ উঠিয়া বটতলায় অপরাহে¦র এই ঘনছায়া ও সম্মুখবর্তী প্রদোষের গভীর অন্ধকার দূর করিবে, স্থানটি যেন তাহারই স্তব্ধ প্রতীক্ষায় নীরবে দাঁড়াইয়া আছে।
ভানুমতীকে কিছু বনের ফুল কুড়াইয়া আনিতে বলিলাম, উহার ঠাকুরদাদার কবরের পাথরে ছড়াইবার জন্য। সমাধির উপর ফুল-ছড়ানো-প্রথা এদের দেশে জানা নাই, আমার উৎসাহে সে নিকটের একটা বুনো শিউলি গাছের তলা হইতে কিছু ফুল সংগ্রহ করিয়া আনিল। তাহার পর ভানুমতী ও আমি দুজনেই ফুল ছড়াইয়া দিলাম রাজা দোবরু পান্নার সমাধির উপরে।
ঠিক সেই সময় ডানা ঝট্পট্ করিয়া একদল সিল্লী ডাকিতে ডাকিতে উড়িয়া গেল বটগাছটার মগডাল হইতে-যেন ভানুমতী ও রাজা দোবরুর সমস্ত অবহেলিত অত্যাচারিত প্রাচীন পূর্বপুরুষগণ আমার কাজে তৃপ্তিলাভ করিয়া সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন-সাধু! সাধু! কারণ আর্যজাতির বংশধরের এই বোধ হয় প্রথম সম্মান অনার্য রাজ-সমাধির উদ্দেশে।
১৫.আরণ্যক – পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
১
ধাওতাল সাহু মহাজনের কাছে আমাকে একবার হাত পাতিতে হইল। আদায় সেবার হইল কম, অথচ দশ হাজার টাকা রেভিনিউ দাখিল করিতেই হইবে। তহসিলদার বনোয়ারীলাল পরামর্শ দিল, বাকি টাকাটা ধাওতাল সাহুর কাছে কর্জ করুন। আপনাকে সে নিশ্চয়ই দিতে আপত্তি করিবে না। ধাওতাল সাহু আমার মহালের প্রজা নয়, সে থাকে গবর্নমেণ্টের খাসমহলে। আমাদের সঙ্গে তার কোনোপ্রকার বাধ্যবাধকতা নাই, এ অবস্থায় সে যে এক কথায় আমাকে ব্যক্তিগতভাবে হাজারতিনেক টাকা ধার দিবে, এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল।
কিন্তু গরজ বড় বালাই। একদিন বনোয়ারীলালকে সঙ্গে লইয়া গোপনে গেলাম ধাওতাল সাহুর বাড়ি, কারণ কাছারির অপর কাহাকেও জানিতে দিতে চাহি না কর্জ করিয়া দিতে হইতেছে।
ধাওতাল সাহুর বাড়ি পওসদিয়ার একটা ঘিঞ্জি টোলার মধ্যে। বড় একখানা খোলার চালার সামনে খানকতক দড়ির চারপাই পাতা। ধাওতাল সাহু উঠানের এক পাশের তামাকের ক্ষেত নিড়ানি দিয়া পরিষ্কার করিতেছিল-আমাদের দেখিয়া শশব্যস্তে ছুটিয়া আসিল, কোথায় বসাইবে, কি করিবে ভাবিয়া পায় না, খানিকক্ষণের জন্য যেন দিশাহারা হইয়া গেল।
-একি! হুজুর এসেছেন গরিবের বাড়ি, আসুন, আসুন। বসুন হুজুর। আসুন তহসিলদার সাহেব।
ধাওতাল সাহুর বাড়িতে চাকর-বাকর দেখিলাম না। তাহার একজন হৃষ্টপুষ্ট নাতি, নাম রামলখিয়া, সে-ই আমাদের জন্য ছুটাছুটি করিতে লাগিল। বাড়িঘর আসবাবপত্র দেখিয়া কে বলিবে ইহা লক্ষপতি মহাজনের বাড়ি।
রামলখিয়া আমার ঘোড়ার পিঠ হইতে জিন খুরপাচ খুলিয়া ঘোড়াকে ছায়ায় বাঁধিল। আমাদের জন্য পা ধুইবার জল আনিল। ধাওতাল সাহু নিজেই একখানা তালের পাখা দিয়া বাতাস করিতে লাগিল। সাহুজীর এক নাতনি তামাক সাজিতে ছুটিল। উহাদের যত্নে বড়ই বিব্রত হইয়া উঠিলাম। বলিলাম-ব্যস্ত হবার দরকার নেই সাহুজী, তামাক আনতে হবে না, আমার কাছে চুরুট আছে।
যত আদর-আপ্যায়নই করুক, আসল ব্যাপার সম্বন্ধে কথা পাড়িতে একটু সমীহ হইতেছিল, কি করিয়া কথাটা পাড়ি?
ধাওতাল সাহু বলিল-ম্যানেজার সাহেব কি এদিকে পাখি মারতে এসেছিলেন?
– না, তোমার কাছেই এসেছিলাম সাহুজী।
– আমার কাছে হুজুর? কি দরকার বলুন তো?
– আমাদের কাছারির সদর খাজনার টাকা কম পড়ে গিয়েছে, সাড়ে তিন হাজার টাকার বড় দরকার, তোমার কাছে সেজন্যেই এসেছিলাম।
মরিয়া হইয়াই কথাটা বলিয়া ফেলিলাম, বলিতেই যখন হইবে।
ধাওতাল সাহু কিছুমাত্র না ভাবিয়া বলিল-তার জন্যে আর ভাবনা কি হুজুর? সে হয়ে যাবে এখন, তবে তার জন্যে কষ্ট করে আপনার আসবার দরকার কি ছিল? একখানা চিরকুট লিখে তহসিলদার সাহেবের হাতে পাঠিয়ে দিলেই আপনার হুকুম তামিল হত।