–আজ বাড়ি ফিরতে পারি তো?
–আরও ক’দিন থাকুন। হাজার-তিনেক টাকা এবার আদায় হয়ে যাবে। প্রজার অবস্থা এবার ভালো।
গদাধর প্রমাদ গণিলেন। একটা রাত যে কষ্টে কাটাইয়াছেন প্রবাসে, আরও কয়েক রাত কাটাইতে হইলেই তো তিনি গিয়াছেন। এমন করে বেশি দিন বাস করা যায়? বিশেষ এই শীতকালে? গদাধরের পিতাঠাকুর বৎসরে দু’বার করিয়া এখানে তাগাদায় আসিতেন–তিনি এই বছর-পাঁচেক পরলোকগত হইয়াছেন– ইহার মধ্যে গদাধর আসিয়াছেন বছর-দুই পূর্বে একবার, আর একবার এই এখন। গোমস্তা পত্র লিখিয়া আসিতে পীড়াপীড়ি না করিলে তিনি বড় একটা এখানে আসিতে চাহেন না। আরামে মানুষ হইয়াছেন, এমন ধরণের কষ্ট তাঁহার সহ্য হয় না!
আরও তিন দিন কাটাইয়া প্রায় দেড় হাজার টাকা আদায় হইল। গাঙ্গুলিমশায় খুব খুশী। কাছারিতে একদিন ভোজের বন্দোবস্ত করিলেন। মাতব্বর প্রজারা জমিদারের নিমন্ত্রণে কাছারিবাড়ি আসিয়া পাত পাড়িয়া খাইয়া গেল। গদাধর নিজে দাঁড়াইয়া থাকিয়া তাহাদের খাওয়ানোর তদারক করিতে লাগিলেন।
সব মিটিয়া গেলে গদাধর গাঙ্গুলিমশায়কে ডাকিয়া বলিলেন– তাহলে আমার যাওয়ার বন্দোবস্ত করুন এবার।
–আজ হয় না বাবু, আজ রাত্রে আমার বাড়ি সত্যনারায়ণ পুজো–আপনাকে একবার সেখানে যেতে হবে।
–বেশ, তবে কাল সকালেই গাড়ির ব্যবস্থা রাখবেন।
–কাল আপনি যাবেন, সঙ্গে আমিও যাবো। অতগুলো টাকা নিয়ে আপনাকে একলা সেখানে যেতে দেবো না বাবু।
–বেশ, তবে কাল সকালেই গাড়ির ব্যবস্থা রাখবেন।
সন্ধ্যার পরে গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি বেশ সমারোহের সহিত সত্যনারায়ণের পূজা হইল। গ্রামের সকলের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ শেষ করিয়া গাঙ্গুলিমশায় উঠানে গ্রাম্য তর্জা-দলের আসর পাতিয়া দিলেন। ঘুমে চোখ ভাঙিয়া আসা সত্ত্বেও গদাধরকে রাত বারোটা পর্যন্ত বসিয়া তৰ্জা শুনিতে হইল–পাঁচ টাকা বকশিশও করিতে হইল, জমিদারী চাল বজায় রাখিতে।
সকালে রওনা হইয়া গদাধর বেলা দশটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছিয়া গেলেন। পাঁচ দিন মাত্র বাহিরে ছিলেন–যেন কতকাল বাড়ি ছাড়িয়াছেন, যেন কতকাল দেখেন নাই স্ত্রী-পুত্রকে! ছোট ছেলে টিপুকে দেখিয়া কাছে বসাইয়া আদর করিয়া তবে মনে হইল, নিজের বাড়িতেই আসিয়াছেন বটে–কতকাল পরে যেন!
অনঙ্গ আসিয়া বলিল–এতদিন থাকতে হবে বলে গেলে না তো? ভালো ছিলে? আমি কাল-পরশু কেবল ঘর-বার করেচি, এই তুমি আসচো…এই তুমি আসচো! তা একটা খবরও তো দিতে হয়!
দুজনে কেহ কখনও কাহাকে ফেলিয়া দীর্ঘদিন থাকে নাই, থাকিতে অভ্যস্ত নয়। নিতান্ত ঘরকোণা গৃহস্থ বলিয়া–পাঁচ দিনের অদর্শন ইহাদের পরস্পরের পক্ষে পাঁচ মাসের সমান!
অনঙ্গ এই পাঁচ দিনের সমস্ত খুঁটিনাটি খবর জিজ্ঞাসা করিতে বসিল। সেখানে কি-রকম খাওয়া-দাওয়া, কে রাঁধিল, থাকার জায়গায় সুবিধা কেমন–ইত্যাদি। গদাধরও সবিস্তারে বর্ণনা করিতে লাগিলেন এই পাঁচ দিনের ব্যাপার–যেন তিনি কাশ্মীর ভ্রমণ সাঙ্গ করিয়া ফিরিলেন।
অনঙ্গ বলিল–কদিন ভালো খাওয়া-দাওয়া হয় নি, আজ কি খাবে বলো?
–যা হয় হবে, আগে একটু চা।
–এত বেলায়? সেখান থেকে চা খেয়ে বেরোও নি–গা ছুঁয়ে বলো তো!
–ওই অমনি এক পেয়ালা।
–এখন আর চা খায় না।
–ওই তোমার দোষ! গরুরগাড়িতে এলাম শরীর ব্যথা করে, একটু গরম চা না হোলে…
–আচ্ছা তবে আধ-পেয়ালা দেবো, তার বেশি কক্ষনো পাবে না।
গদাধর এ-কথা বলিলেন না যে গত পাঁচদিন কাছারিবাড়িতে মনের সাধ মিটাইয়া এবেলা চার পেয়ালা, ওবেলা চার পেয়ালা প্রতিদিন চালাইয়াছেন! আজও সকালে আসিবার আগে দুটি পেয়ালা উজাড় করিয়া তবে গাড়িতে উঠিয়াছিলেন!
অনঙ্গ চা আনিয়া দিয়া বলিল–নির্মল তোমায় খুঁজে খুঁজে হয়রান!
-কেন?
-তা আমায় বলে নি, রোজ এসে বলে–বৌদি, আজ এ খাওয়াও, বৌদি, আজ ও খাওয়াও–বিরক্ত করেছে।
-তাতে কি হয়েচে? বন্ধুলোক–খাবে না? আদর করে কেউ খেতে চাইলে…
–সে আমি জানি গো জানি। তোমার বন্ধু খেতে পায় নি তা নয়–আমি তেমন বাপের মেয়ে নই। খেতে চেয়ে কেউ পায় না, এমন কখনো হয় নি আমার কাছে।
–সে কথা যাক। এখন আমাকে কি খেতে দেবে বলো?
–অনঙ্গ হাসিয়া বলিল–এখন বলবো না, খেতে বসে দেখবে!
–কি শুনি না?
–পিঠে-পুলি, পায়েস।
–খুব ভালো। সেখানে বসে বসে ভাবতাম, শীতকালে একদিন পিঠে মুখে ওঠেনি এখনও।
–যত খুশী খেও এখন।
স্ত্রীর সেবা-যত্নের হাত ভালো। অনঙ্গ কাছে বসিয়া স্বামীকে যত্ন করিয়া খাওয়াইল, পান সাজিয়া ডিবায় আনিয়া বিছানার পাশে রাখিয়া বলিল-ঘুমোও একটু। গাড়িতে আসতে বড় কষ্ট হয়েচে, না?।
গদাধর আদর বাড়াইবার জন্য বলিলেন–পিঠটায় যা ব্যথা হয়েচে–একেবারে শিরদাঁড়ায়!
অনঙ্গ ব্যস্ত হইয়া বলিল–এতক্ষণ বলো নি? দাঁড়াও তেল গরম করে আনি।
–এখন থাক। ঘুমিয়ে উঠি, তারপর।
–আমি যাই, মশারি ফেলে দিয়ে আসি। মাছি লাগবে।
গদাধরের ঘুম ভাঙিল বৈকালের দিকে। সত্যই গায়ে ব্যথা হইয়াছে বটে, তিনি যে স্ত্রীকে নিতান্ত মিথ্যা বলিয়াছেন–এখন দেখা যাইতেছে তাহা নয়। সেদিন সন্ধ্যার দিকে গদাধরের জ্বর আসিল। রাত্রে কিছু খাইলেন না–অনঙ্গ ডাক্তার ডাকাইল, কুইনাইনের ব্যবস্থা হইল। কারণ ডাক্তারের মতে এটা খাঁটি ম্যালেরিয়া-জ্বর ছাড়া আর কিছু নয়।