জিজ্ঞাসা করিয়া আসিয়া গাড়োয়ান জানাইল, ডাল নাই।
–তবে দেখ, ভালো তামাক আছে?
জানা গেল তামাক আছে–তবে চাষী লোকের উপযুক্ত, ভদ্রলোক সে তামাক খাইতে পারিবে না।
গদাধর বিরক্ত মুখে বলিলেন–পার হ দেখি, সাবধানে গাড়ি নামা নদীতে। আমি কি নেমে যাবো?
–নামবেন কেন বাবু, গাড়িতে বসে থাকুন। ভয় নেই।
গাড়ি পার হইয়া ওপারে গেল। লম্বা শিশু-গাছের সারি…তলা দিয়া রাস্তা।
অন্ধকার নামিয়া আসিল। গদাধর গাড়োয়ানকে বলিলেন– হুঁশিয়ার হয়ে চল, এ পথ ভালো নয়।
গাড়োয়ান পিছন ফিরিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়াই আবার সামনের দিকে মুখ ফিরাইয়া গরুর লেজ মলিতে মলিতে বলিল– কোন্ ভয়ডার কথা বলচেন বাবু? ভূতির, না মানুষির?
–ভূতটুত নয় রে বাপু। মানুষের ভয়ই বড় ভয়।
–কোনো স্তর করবেন না বাবু–সে-সব এদানি আর নেই।
–তুই তো সব জানিস। আর বছর চত্তির মাসে এ-পথে রাধানগরের সাতকড়ি বসাককে খুন করে, মনে নেই?
গাড়োয়ান চুপ করিয়া রহিল। তাহাতে গদাধর যেন বেশি ভয় পাইলেন, বলিলেন–কি, কথা বলচিস্ নে যে বড়?
–কথা মনে পড়েচে, বাবু।
–তবে? হুঁশিয়ার হয়ে চল!
–চলুন বাবু, যা কপালে থাকবার, হবে।
-বুঝলাম। নে, একটু তামাক সাজ দিকি। চকমকি আছে, সোলা আছে, নে…
সত্যই ঘোর অন্ধকার হইয়া গিয়াছে। গদাধরের হাতে টাকাকড়ি নাই সত্য–কিন্তু সোনার আংটি আছে, বোতাম আছে–সামান্য দশ-বারো টাকা নগদও আছে। পল্লীগ্রামে লুটেরাডাকাতের পক্ষে ইহাই যথেষ্ট। ইহার অপেক্ষা অনেক কম অর্থের জন্যও তাহারা মানুষ খুন করিয়াছে বলিয়া শোনা গিয়াছে।
গাড়োয়ানটা কথা বলে না কেন? গদাধর বলিলেন–কি রে, জ্বাললি?
–আজ্ঞে বাবু, সোলা ভিজে।
–তোর মুণ্ডু! দে, আমার কাছে দে দিকি!
গদাধরের আসল উদ্দেশ্য তামাক খাওয়া নয়, কথাবার্তায় ও হাতের কাজ লইয়া ভয়ের চিন্তা ভুলিয়া অন্যমনস্ক থাকা। তামাক ধরাইয়া নিজে খাইয়া গাড়োয়ানকে কলিকা দিবার সময় যেন তাঁহার মনে হইল রাস্তার পাশেই গাছের সারির মধ্যে সাদামত কি নড়িতেছে!
গাড়োয়ানকে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিলেন–কি রে গাছের পাশে?
গাড়োয়ান ভালো করিয়া দেখিয়া বলিল–ও কিছু না বাবু। আপনি ভয় পাবেন না–এ-পথে গাড়ি চালিয়ে বুড়ো হয়ে মরতি গ্যালাম, ভয়-ভীত কিছু নেই বাবু। শুয়ে পড়ুন ছইয়ের ভেতর।
কিন্তু গাড়োয়ানের কথায় গদাধরের ভয় গেল না। তিনি ছইয়ের ফাঁক দিয়া একবার এদিক, একবার ওদিক দেখিতে দেখিতে দূর হইতে সোনামুড়ির ডোমপাড়ার আলো দেখিলেন। আর ভয় নাই, সোনামুড়িতে লোকজনের বাস আছে–মধ্যে একটা বড় মাঠ– তারপরই ঢবঢবির বিল চোখে পড়িবে।
সোনামুড়ি গ্রামে ঢুকিতেই দেখা গেল, তাঁহার কাছারির পিয়াদা মানিক শেখ লণ্ঠন হাতে আসিতেছে তাঁহাদের আগাইয়া লইতে।
মানিক সেলাম করিয়া বলিল–বাবু আসচেন?
–হ্যাঁ রে…গোমস্তামশায় কোথায়?
-কাছারিতে বসে আছেন। বাবুর খাওয়ার জোগাড় করতি পাঠালেন মোরে–দুধের বন্দোবস্ত করিতে এয়েলাম ডোমপাড়ায়।
–চ গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে।
কাছারি পৌঁছিয়া গাড়ি রাখা হইল। গদাধর নামিয়া কাছারির মধ্যে ঢুকিতেই গোমস্তা গাঙ্গুলিমশায় লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন– আসুন বাবু, আসুন। আপনার জন্যে সন্দে থেকে বসে আছি এই আসেন, এই আসেন! বড্ড দেরি হয়ে গেল বাবুর। খাওয়া দাওয়ার সব ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত করে রেখেচি।
-নমস্কার গাঙ্গুলিমশায়, ভালো আছেন?
–কল্যাণ হোক, বসুন। ওরে বাবুর হাত-পা ধোয়ার জল এনে দে বাইরে।
গদাধর হাত-মুখ ধুইয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া আদায়পত্র সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলেন।
রাত বেশি হইল, নিকটেই ব্রাহ্মণপাড়ায় গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি হইতে খাবার আসিল। আহারাদি সারিয়া শুইবার সময় গদাধর বলিলেন–রাত্রে এখানে মানিক শেখকে থাকতে বলুন গাঙ্গুলিমশায়। একা থাকা, মাঠের মধ্যে কাছারি…
গাঙ্গুলিমশায় হাসিয়া বলিলেন–কোনো ভয়-ভীত নেই এখানে। মানিকও থাকবে-এখন–আপনি নিশ্চিন্দি হয়ে শুয়ে পড়ুন।
গদাধর গৃহস্থ মানুষ। নিজের বাড়ি ছাড়িয়া অন্যত্র শুইতে খুব বেশি অভ্যস্ত নহেন, তাঁহার কেমন ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকিতে লাগিল। এ-ধরণের ঘরে মানুষ শুইতে পারে? টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়া হিম আসিতেছে দস্তুরমত। অনঙ্গ কাছে নাই–ছেলে মেয়ের কথা মনে পড়িয়া বিশেষ করিয়া কষ্ট হইতে লাগিল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত এপাশ ওপাশ করিবার পরে গভীর রাত্রে তন্দ্রাবেশ হইল। শেষরাত্রে আবার ঘুম ভাঙিয়া গেল। কোথায় শুইয়া আছেন–ঢবঢবির কাছারিবাড়িতে? কেমন একটু ভয়-ভয় হইল। ডাকিলেন–মানিক, ও মানিক…
মানিক সম্ভবত গভীর নিদ্রায় মগ্ন। সাড়া পাওয়া গেল না।
গদাধর আবার ঘুমাইয়া পড়িলেন।
ভোর হইলে গদাধর উঠিয়া হাতমুখ ধুইয়া কাছারিতে বসিলেন। প্রজাপত্র আসিতে আরম্ভ করিল। কেহ একটা পাঁঠা, কেহ বা গোটাকতক ডিম, কেহ বড় একটা লাউ প্রভৃতি আনিয়াছে জমিদারবাবুকে ভেট দিতে। নানাবিধ জিনিসপত্রে কাছারি-ঘর ভরিয়া গেল–তার মধ্যে তরিতরকারিই বেশি। বেলা এগারোটার মধ্যে প্রায় সাতশত টাকা আদায় হইল।
গাঙ্গুলিমশায় বলিলেন–বাবু আপনি এসেচেন বলে এই আদায়টা হলো। নইলে এ টাকা আদায় হতে একমাস লাগতো। আপনাদের নামে যা হবে, আমার হাজার-বার তাগাদাতেও তা। হবে না।