নির্মল বলিল–আমিও ভাই এবার চলি, কাজ আছে, একবার শিবুর মায়ের কাছে যাবো। বুড়ি আজ কদিন ধরে রোজ ডেকে পাঠাচ্চে, তাঁর ছেলের সন্ধান করে দিতে হবে। দেখি গিয়ে।
-ভালো কথা, তার আর কোনো সন্ধান পাও নি?
সন্ধান আর কি পাবো? কলকাতাতেই আছে, চাকরি খুঁজতে গিয়েচে। দুদিন পরে এসে হাজির হবে। এক্ষেত্রে যা হয়–মামার তাড়ায় আর বকুনিতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। যেমন মামা, তেমনি মামী।–এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ।
-মাঝে পড়ে শিবুর মা’র হয়েচে বিষম দায়। ভাইয়ের বাড়ী পড়ে থাকে, সহায়-সম্পত্তি নেই–এই বয়সে যায়ই বা কোথায়? তার ওপর ছেলেটির ওই ব্যাপার।
–আচ্ছা তাহলে আসি ভাই।
দাঁড়াও, দাঁড়াও।
দরজা পর্যন্ত যাইয়া গদাধর নির্মলের হাতে তিনটি টাকা গুঁজিয়া দিলেন।
–এ আবার কেন, এ আবার কেন? বলিতে বলিতে নির্মল টাকা ক’টি ট্যাকে গুঁজিয়া চলিয়া গেল গায়ে সে জামা দিয়া আসে নাই–মাত্র গেঞ্জি গায়ে আসিয়াছিল।
গদাধর বাড়ীর ভিতর ঢুকিয়া দেখিলে, অনঙ্গ তখনও বসিয়া বসিয়া একরাশ লুচি ভাজিতেছে। একটু বিস্ময়ের সুরে বললেন–এ কি গো, এত লুচির ঘটা কেন আজ বলো তো?
–কেন আর, আমি খাবো! আমার খেতে নেই? এ সংসারে শুধু খেটেই মরবো, ভালো মন্দ খাবো না?
-না, আজ এত কেন–তাই বলচি
অনঙ্গ টানিয়া টানিয়া বলিল–তুমি খাবে, আমি খাবো, ভড় মশায় খাবেন,–সবাইকে যে নেমন্তন্ন করেচি আজ, জানো না?
বলিয়া স্বামীর মুখের দিকে কৌতুকোজ্জ্বল হাসিমুখে চাহিতেই গদাধর বুঝিলেন, স্ত্রীর কথা সর্বৈব মিথ্যা। স্ত্রীর এই বিশেষ ভঙ্গিটি তিনি আজ তেরো বৎসর ধরিয়া দেখিয়া আসিতেছেন–কৌতুক করিয়া মিথ্যা বলিবার পরে ভঙ্গিটি করিয়াই অনঙ্গ নিজের মিথ্যা নিজে ধরাইয়া আসিতেছে চিরকাল–অথচ খুব সম্ভব সে নিজে তাহা বুঝিতে পারে না।
গদাধর হাসিয়া বলিলেন–ভালোই তো, আমি কি বারণ করেচি?
–নাগো না, আজ শিবুর মাকে রাত্রে এখানে খেতে বলেছি। আহা, বুড়ীর বড় কষ্ট। ছেলেটা অমনি হলো, ভাই-বউয়ের যা মুখ-ঝংকার! ক্ষুরে নমস্কার, বাবা! বুড়ীকে দাঁতে পিষতে শুধু বাকি রেখেচে! না দেয় দুটো ভালো করে খেতে, না দেয় পরনে একখানা ভালো কাপড়–কি করে যে মানুষ অমন পারে।
-তা বেশ, ভালো ভালো। খাওয়াও না। আমায় আগে বললে না কেন? একদিনের জন্যে যখন খাওয়াবে, তখন একটু ভালো করেই খাওয়াতে হয়। রাধানগর থেকে সন্দেশ মিষ্টি আনিয়ে দিতাম–হলো-বা একটু দই…
–দই ঘরে পেতেছি। খাসা দই হয়েচে। খেও একটু-পাতে দেবো এখন। মিষ্টি তো পেলাম না–নারকোলের সঙ্গে ক্ষীর মিশিয়ে সন্দেশ করবো ভাবচি।
–এখনও করবে ভাবচো? কত রাত্রে বুড়ীকে খেতে দেবে?
–সব তো হয়ে গেল। লুচি ক’খানা ভাজা হয়ে গেলেই নারকোল কুরে বেটে সন্দেশ চড়িয়ে দেবো। ক্ষীর করে রেখেচি–ওগো, আমায় একটু কপপুর আনিয়ে দাও না!
–এখন কি কপপুর পাওয়া যাবে? আগে থেকে সব বলো না কেন? এ কি কলকাতা শহর? রাধানগর ভিন্ন জিনিস মেলে? দেখি, বিশুর দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েচে কিনা। যদি পাওয়া যায়, পাঠিয়ে দিচ্ছি।
গদাধরের পৈতৃক আমলের ছোট একখানি তালুক ছিল। সেখানে ইঁহাদের একটি কাছারিঘর ও বহুকালের পুরানো গোমস্ত বিদ্যমান।
বেশ শীত পড়িয়াছে–একদিন গদাধর স্ত্রীকে একখানা চিঠি দেখাইয়া বলিলেন–ওগো, আজ সকাল সকাল রান্না করে ফেল তো–আমপাড়া ঢবঢবির গোমস্তা পত্র লিখেচে, কিছু আদায় তশিল দেখে আসি।
অনঙ্গ পছন্দ করে না, স্বামী কোথাও গিয়ে বেশিদিন থাকে। কথা শুনিয়া তাহার মুখ শুকাইয়া গেল। স্বামীর মুখের দিকে। চাহিয়া বলিল–কতদিন থাকবে?
তা ধরো যে ক’দিন লাগে–দিন-ছ’সাত হবে বোধ হচ্চে।
–এত দিন তো কোনোকালে থাকো না। আমপাড়া ঢবঢবি শুনেচি অতি অজপাড়াগাঁ। খাবে-দাবে কি? থাকবে কোথায়?
গদাধর হাসিয়া বলিলেন–সে ভাবনা তোমার চেয়ে আমার কম নয়, কারণ আমি সেখানে থাকবো। আমাদের সেখানে কাছারিবাড়ী আছে, ভাবনা কি? গাঙ্গুলিমশাই বহুকালের গোমস্তা, সব ঠিক করে রাখবেন।
অনঙ্গ চিন্তিত মুখে বলিল–সেদিন অমন সর্দি-কাশি গেল, এখনো তেমন সেরে ওঠো নি। ভারি তোমাদের কাছারিঘর! টিনের বেড়া, খড়ের ছাউনি! গলগল করে হিম আসে–কি করে। কাটাবে তাই ভাবচি–এখন না গেলেই নয়?
–কি করে না গিয়ে পারা যায়। পৌষ-কিস্তির সময় এসে পড়লো, যেতেই হবে।
–আজই কেন, কাল যেও।
–যখন যেতেই হবে, তখন আজ আর কাল করে কি লাভ? বরং যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়….
–আমায় নিয়ে চলো।
গদাধর বিস্ময়ের সুরে বলিলেন–তোমাকে! ঢবঢবির কাছারিবাড়িতে। সে জায়গা কেমন তুমি জানো না, তাই বলচো। পুরুষমানুষে থাকতে পারে–মেয়েমানুষ থাকবে কোথায়? একখানা মোটে ঘর–সে হয় কি করে?
–অতদিন লাগিও না, দু’তিন দিনের মধ্যে এসো তবে।
কাজ শেষ হলে আমি কি সেখানে বসে থাকবো–চলে আসবো!
গদাধর বেলা দুইটার পরে গরুর গাড়িযোগে আমপাড়া রওনা হইলেন। ছ’সাত ক্রোশ পথ–মাঠ ও বিলের ধার দিয়া রাস্তা– ঠাণ্ডা হাওয়ায় সন্ধ্যার দিকে বেশ শীত করিতে লাগিল।
গদাধর গাড়োয়ানকে বলিলেন–সামনে তো কাপাসডাঙ্গা, তারপর নদী পেরুবি কি করে? জল কত?
–জল নেই। হেঁটে পার হওয়া যায়।
নদীর ধারে ছোট্ট দোকান। অনঙ্গ পাঁচ-ছদিনের মত চাল, ডাল, মশলা, তেল, ঘি কিছুই দিতে বাকি রাখে নাই, তবুও গদাধর গাড়োয়ানকে বলিলেন–দেখ তো, সোনামুগের ডাল আছে কিনা দোকানে?