–দিক না-দিক, তোমার সে-সব খোঁজে দরকার কি? তুমি মেয়েমানুষ–বাইরের সব কথায় থেকো না বলচি।
নির্মলের ব্যাপার লইয়া সেদিন ভড়মশায় আড়তেও গদাধরকে দু’একটা কথা বলিয়াছিল।
গদাধর জেদী লোক–যাহাকে লইয়া ঘরে-বাহিরে তাঁর উৎপীড়ন, তাহাকে তিনি কখনই ত্যাগ করিতে পারেন না-করিবেনও না। আসলে নির্মল মুখুয্যে এ-গ্রামের হরি গাঙ্গুলির জামাই। শ্বশুরকুল নির্মূল হওয়াতে বর্তমানে শ্বশুরের সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে ভোগদখল করিতেছে। লোকটি সর্বদাই অভাবগ্রস্ত, এ-কথাও ঠিক–কারণ আয়ের অনুপাতে তাহার ব্যয় বেশি।
নির্মল মুখুয্যে আসিয়া বাহির হইতে হাঁকিল–গদাধর আছো না কি হে! আসবো?
গদাধর উত্তর দিবার পূর্বেই অনঙ্গ বলিল–উত্তর দাও তো দেখিয়ে দেবো মজা!
গদাধর হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন–তোমার সব তাতেই ভয়! জবাব দিলে আমাকে খেয়ে ফেলবে না তো।
দৃঢ় চাপা-কণ্ঠে অনঙ্গ বলিল–না।
–ভদ্রলোকের ছেলে বাড়ীতে এসেছে…
–আসুক।
ইঁহাদের কথা শেষ হইবার পূর্বেই নির্মল মুখুয্যে একেবারে ঘরের দোরের কাছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আসিয়া পড়িল।
–কি গো বৌ-ঠাকরুণ, আমাদের বাড়ী যাওয়া একেবারে ছেড়ে দিলে যে–রাগ করলে নাকি গরীবদের ওপর?
অনঙ্গ নির্মলের কথার ভাবে হাসিয়া বলিল–কেন, রাগ করবো কেন?
–কাজ দেখেই লোক লোকের বিচার করে–তোমার কাজ দেখেই বলচি।
–না, রাগ করি নি।
–শুনে মনটা জুড়লো।
–থাক, আর ঠাট্টায় কাজ নেই।
–এটা ঠাট্টা হলো বৌ-ঠাকরুণ? যাক, এখন কি খাওয়াবে খাওয়াও তো সন্দেবেলা…
সন্দেবেলা মানে, রাত্তিরে!
–রাত একে বলে না, এর নাম সন্দে।
–কি আর খাওয়াবো? ঘরে কি-বা আছে? আচ্ছা বসুন, দেখি।
গদাধর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলেন! দু’জনের মধ্যে একটা মিটমাট হইতে দেখিয়া নির্মলের দিকে চাহিয়া বলিলেন– কি মনে করে, এখন বলো? তোমার সঙ্গে অনেক কাল দেখা নেই।
–ব্যস্ত ছিলাম ভাই, আমাদের খেটে খেতে হয়।
–আমাদেরও উঠোনে পয়সা ছড়ানো থাকে না–খুঁজে নিতে হয়!
–আমাদের যে খুঁজলেও মেলে না, সেই হয়েচে মুশকিল।
–সন্দেবেলাটা বড় কাজ পড়ে গিয়েচে আজকাল, নইলে তোমার ওদিকে যেতাম।
-আমারও তাই, নইলে আগে তো প্রায়ই আসতাম।
–দ্যাখো ভাই নির্মল, একটা কথা তোমায় বলি। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে তোমার তো লোক আছে–আমায় কিছু কাজ পাইয়ে দাও না?
–নিজের কাজ ফেলে আবার পরের কাজ করতে যাবে কেন? তাছাড়া ওতে বড় ঝঞ্ঝাট!
— ঝঞ্ঝাট সহ্য করতে আর কি–টাকা রোজগার নিয়ে বিষয়। ওতে আমার অসুবিধে হবে না–তুমি চেষ্টা করো না?
নির্মল কিছু ভাবিয়া বলিল–কিছু টাকা গোড়ায় ছাড়তে পারবে?
–কি রকম?
–তোমার কাছে আর ঢাকাঢাকি কি, কিছু টাকা পান খাওয়াতে হবে–এই…বোঝ তো সব!
–কত?
–সে তোমায় বলবো। আন্দাজ শ’পাঁচেক–কিছু বেশীও হতে পারে।
গদাধর সাগ্রহে বলিলেন–তুমি দ্যাখো ভাই নির্মল। এ-টাকা আমি দেবো–তবে আমার আবার পুষিয়ে যাওয়া চাই তো! বুঝলে না, ঘর থেকে তো আর দেবো না!
–আমি সব বুঝি। সে হয়ে যাবে। যেমন দান, তেমনি দক্ষিণে।
–কবে আমায় জানাবে? ওরা কিন্তু টেন্ডার কল করেচে পনেরো তারিখের পরে আর টেন্ডার নেবে না।
–তাহলে কাল আমি একবার যাই–গিয়ে দেখে আসি, কি বলো?
–বেশ ভাই, তাই যাও। যাতে হয়–বুঝলে তো, তোমাকে আর বেশি কি বলবো!
এই সময় অনঙ্গমোহিনী দু’খানি রেকাবিতে লুচি, আলুভাজা ও হালুয়া লইয়া ঘরে ঢুকিয়া দু’জনের সামনে রেকাবি দুটি রাখিল।
নির্মল হাসিমুখে বলিল–এই তো! এতেই তো আমি বৌ ঠাকরুণকে বলি–চোখ পালটাতে না পালটাতে এত খাবার তৈরি হয়ে গেল!…তা এত লুচি কেন আমার রেকাবিতে!
অনঙ্গ হাসিয়া বলিল–খান, ও ক’খানা আপনি পারবেন এখন খেতে। চা খাবেন তো?
–তা এক পেয়ালা হলে মন্দ হয় না।
স্বামীর দিকে চাহিয়া অনঙ্গ বলিল–তোমার কিন্তু দু’ পেয়ালা গিয়েচে, তোমাকে আর দেবো না।
গদাধর বিমর্ষ ভাবে বলিলেন–তা যা হয় করো। তবে না হয় আধ পেয়ালা দিও।
–কিছু না–সিকি পেয়ালাও না। রাত্রে তারপর ঘুম হবে না– মনে নেই?
অনঙ্গ মুখ ঘুরাইয়া চলিয়া গেল।
নির্মল বলিল–টাকাটার তাহলে যোগাড় করে রেখো।
–শ’পাঁচেক তো? ও আর কি যোগাড় করবো, গদির ক্যাশ থেকে নিলেই হবে–নিজনামে হাওলাত লিখে!
–তাহলে কাল একবার যাই, কি বলো?
–হ্যাঁ যাবে বই-কি–নিশ্চয় যাবে।
অনঙ্গ চা লইয়া আসিল। গদাধরের জন্য আনে নাই, শুধু নির্মলের জন্য। গদাধর জানেন তাঁহার স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত খুঁটিনাটি লইয়া স্ত্রী বড়ই নির্মম–এখন হাজার চাহিলেও চা মিলিবে না। সুতরাং তিনি এ-বিষয়ে আর উচ্চবাচ্য করিলেন না। নির্মল বলিল–চলো বৌ-ঠাকরুণ, একদিন সবাই মিলে আড়ংঘাটায় ‘যুগলকিশোর’ দেখে আসি।
–বেশ তো, চলুন না।
গদাধর বলিলেন–সে এখন কেন? জষ্টি মাসে দেখতে হয় তো!
যুগল দেখিলে জ্যৈষ্ঠ মাসে
পতিসহ থাকে স্বর্গবাসে।
স্ত্রীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন–অতএব তোমার যদি আমার সঙ্গে স্বর্গবাসে মন থাকে, তাহলে
অনঙ্গ সলজ্জ মুখে বলিল–যাও, সব-তাতেই তোমার ইয়ে! আমরা এখুনি যাবো–-চলো না! পরে আবার জষ্টি মাসে গেলেই হবে। আমি কখনো দেখিনি–জষ্টি মাস পর্যন্ত বাঁচি কি মরি!
নির্মল বলিল–ও আবার কি অলুক্ষুণে কথা! মরবেন কেন ছাই! বালাই…ষাট…
অনঙ্গ হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল।