মেয়েটি একটুকরা কাগজে ঠিকানা লিখিয়া তাঁহার হাতে দিয়া বলিল–ট্রাম থেকে নেমে বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে খানিকটা গেলেই পাবেন। দেখবেন, লেখা আছে ন্যাশনাল ফিল্ম কোম্পানীর নাম, গেটের মাথায় আর দেওয়ালের গায়ে।
রাস্তায় পড়িয়া পথ হাঁটিতে হাঁটিতে কিন্তু ভড়মশায়ের মনে আনন্দের ভাবটা আর রহিল না। মনিব জেলে যান নাই–আবার সেই ছবি-তোলার কাজই করিতেছেন, অথচ এই এক বৎসরের মধ্যে একবার স্ত্রীপুত্রের খোঁজখবর করেন নাই, এ কেমন কথা? এস্থলে আনন্দ করিবার মত কিছু নাই, বরং ইহার মূলে কি রহিয়াছে, তাহা দেখিয়া যাওয়াটা দরকার। ভড় মশায়ের মন বেশ দমিয়া গেল।
দমিয়া গেলেও, সেই মন লইয়াই অগত্যা পথ চলিতে চলিতে একসময় তিনি ট্রামে উঠিয়া পড়িলেন। ট্রাম যথাসময়ে টালিগঞ্জ ডিপোয় আসিয়া পৌঁছিল। অন্যান্য সহযাত্রীরা একে একে নামিয়া যাইতেছে দেখিয়া ভড়মশায়ের হুঁশ হইল, তাঁহাকেও এবার নামিতে হইবে। ভড়মশায় ট্রাম হইতে রাস্তায় নামিয়া আবার হাঁটিতে শুরু করিলেন।
মেয়েটির নির্দেশমত বাঁ-দিকের পথ ধরিয়া হাঁটিবার সময় দেখিলেন, ভিন্ন ভিন্ন ছোট ছোট দল যেসব কথাবার্তা কহিতে কহিতে চলিয়াছে ঐ পথে, তাহাদের মৃদুগুঞ্জনে বেশ বুঝা যাইতেছে যে তাহারা সকলেই এখন ভড়মশায়ের লক্ষ্যপথের পথিক। যে কোনো কাজের জন্যই যাক না কেন, তাহারাও চলিয়াছে ঐ স্টুডিওর উদ্দেশে।
কিছু পথ যাইতেই চোখে পড়িল, সামনে অনেকখানি জায়গা করোগেট টিন দিয়া ঘেরা মস্ত বাগান, আর সেই বাগানের কাছে পৌঁছিয়াই তিনি নিশ্চিত বুঝিলেন যে, তাঁহার ঈপ্সিত স্থানে আসিয়া গিয়াছেন। ঐ বাগানের ফটক। ফটকের দুইদিকে থামের মাথায় অর্থবৃত্তাকারে লোহার ফ্রেমে সোনালী অক্ষরে জ্বলজ্বল। করিতেছে—‘ন্যাশনাল ফিল্ম স্টুডিও’।
মা-কালীকে স্মরণ করিয়া গেটের মধ্যে সবে পা দিয়াছেন, এমন সময় পিছন হইতে কোমরে আঁকশি দিয়া কে যেন টানিয়া ধরিল। ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলেন, ইয়া গালপাট্টাওয়ালা পশ্চিমা পহলবানের মত এক দীর্ঘবপু দরওয়ানজী হাঁকিয়া বলিতেছে কাঁহা যাতা?
ভড়মশায় বলিলেন–যাঁহা আমার বাবু আছেন।
দরওয়ানজী হাঁকিল–গেট-পাশ হ্যায়?
–হাঁ হ্যায়। আমার বাবুর কাছ থেকে এখুনি নিয়ে আতা হ্যায়, এনে তোমায় দিয়ে দেবো।
পহেলা ল্যাও, লে-আয়কে অন্দরমে ঘুসো।
–বেশ, এখুনি এনে দিচ্ছি, তোমারা কোনো চিন্তা নেই হ্যায়।
কথাটা বলিয়া ভড়মশায় অগ্রসর হইবার উপক্রম করিতেই আবার পশ্চাৎদিক হইতে শব্দের আকর্ষণ…কেঁউ, বাত মানেগা নেহি? মত যাও…লৌটকে আও…
অগত্যা ভড়মশায়কে ফিরিতে হইল। এই বয়সে শেষে কি একজন খোট্টার কাছে অপমানিত হইবেন?
ওই দেখা যায় একটা সুপারি গাছ–তার পাশেই মস্ত বড় পুকুর। পুকুরের ওপারে টিনের ছাদ-আঁটা মস্ত একটা গুদামের মতো, সেখানে কত লোক চলিতেছে ফিরিতেছে…সকলেই যেন খুব ব্যস্ত। ভড়মশায় ভিতরে ঢুকিতে না পাইয়া নিজের নিরুপায় অবস্থার কথা ভাবিতে ভাবিতে নিশ্চিত বুঝিলেন যে, ঐখানেই ছবি তোলার কাজ হইতেছে। তারপর দ্বারবানের নিকটে আসিয়া সে কি আকুতি! দ্বারবান ভিতরে যাইতে দিবে না, ভড়মশায়কেও যাইতেই হইবে। মিনতি যখন কলহে পরিণত হইবার উপক্রম, এমন সময় একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। ভড়মশায়কে দেখিয়া লোকটি বলিল–কাকে চান? ওদিকে কোথায় যাচ্চেন?
–আজ্ঞে, আমি গদাধর বসু মহাশয়কে খুঁজচি–নিবাস কাঁইপুর, জেলা…
–বুঝেচি। আপনি ওখানে যাবেন না। ওখানে সেট সাজানো হচ্চে–ওখানে যেতে দেবে না আপনাকে। মিঃ বোসের আসবার সময় হয়েচে–এখানে আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন, মোটর এসে এখানে থামবে।
–আজ্ঞে আপনার নাম?
ভদ্রলোকে ব্যস্তভাবে বলিলেন–কোনো দরকার আছে? শান্তশীল রায়কে খুঁজে নেবেন এর পরে–আমার সময় নেই, যাই–আমাকে এখুনি সেটে যেতে হবে।
ভড়মশায় সেখানে বোধহয় পাঁচ মিনিটও দাঁড়ান নাই, এমন সময় একখানা মাঝারি গোছের লালরঙের মোটর আসিয়া তাঁহার সামনে লাল কাঁকরের রাস্তার উপর দাঁড়াইল।
ভড়মশায় তাড়াতাড়ি আগাইয়া গেলেন, কিন্তু দেখিলেন মোটর হইতে নামিল দুটি মেয়ে, হাতে তাদের ছোট ছোট ব্যাগ–তাহারা নামিয়াই দ্রুতপদে পুকুরের পাড়ে চলিয়া গেল।
আরও কিছুক্ষণ পরে আর-একখানি মোটর আসিয়া দাঁড়াইল। এবার ভড়মশায়ের বিস্মিত ও বিস্ফারিত দৃষ্টির সম্মুখে নামিলেন গদাধর ও তাঁহার সঙ্গে একটি সুবেশা মহিলা। ভড়মশায় চিনিলেন, মেয়েটি সেই শোভারাণী মিত্র। ড্রাইভারের পাশের আসন হইতে তকমা-পরা এক ভৃত্য নামিয়া তাঁহাদের জন্য গাড়ির দোর খুলিয়া সসম্ভ্রমে একপাশে দাঁড়াইয়াছিল, সে এবার একটা ব্যাগ হাতে তাঁহাদের অনুসরণ করিল।
ভড়মশায় আকুলকণ্ঠে ডাকিলেন–বাবু, বাবু…
কিন্তু পিছনের ভৃত্যটি একবার তাঁহার দিকে চাহিয়া দেখিল মাত্র, গদাধর ও মহিলাটি ততক্ষণে দ্রুতপদে পুকুরের পাড়ের রাস্তা ধরিয়াছে, বোধ হয় ভড়মশায়ের ডাক তাঁহাদের কানে পৌঁছিল না।
ভড়মশায় কি করিবেন ভাবিতেছেন–এমন সময় পূর্বের সেই তরুণবয়স্ক ভদ্রলোকটিকে এদিকে আসিতে দেখিতে পাইলেন।
ভড়মশায়কে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া তিনি কাছে আসিয়া বলিলেন–কি, এখনও দাঁড়িয়ে আছেন যে? দেখা হয়নি? এই তো গেলেন উনি!